সবুজে ঘেরা বড়সড় এক মাঠ। পড়ন্ত বিকেলে সেখানে ক্রিকেট খেলছেন একদল তরুণ। তবে এটি মফস্সল শহরের স্কুলের মাঠের কোনো দৃশ্য নয়। এ চিত্র ডেনিম কাপড় উৎপাদনের একটি কারখানার মাঠের। আর খেলোয়াড়েরা সেই কারখানার কর্মী।
বিশাল এই মাঠসহ বিশাল এলাকা নিয়ে হবিগঞ্জের মাধবপুরের হরিতলা এলাকায় পাইওনিয়ার ডেনিম কারখানা গড়ে তুলেছেন তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের সফল উদ্যোক্তা বাদশা মিয়া। দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের পাশাপাশি পুরো কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে এরই মধ্যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিবিসির লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। বিভিন্ন মানদণ্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে কারখানাটি পেয়েছে ৮৩ নম্বর।
২০১৮ সালে উৎপাদনে যাওয়া পরিবেশবান্ধব এই কারখানায় প্রতি মাসে ৭০ লাখ গজ ডেনিম কাপড় তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। আর এসব ডেনিম কাপড় বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ইনডিটেক্স, নেক্সট, এইচঅ্যান্ডএমসহ ৪৮টি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চলতি বছর ১২ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) বিকেলে পুরো কারখানা ঘুরে ও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫০ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এই কারখানায় কাজ করেন আড়াই হাজার কর্মী। প্রধান ফটক পেরিয়ে কারখানায় ঢুকতেই বিশাল খোলা জায়গা। তার এক পাশে সবজি ও ফলমূলের চাষ করা হয়েছে। তারপর একের পর এক কারখানা ভবন। কর্মীদের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য কারখানা চত্বরজুড়ে ৮০ ফুট চওড়া সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কের দুই পাশে সবুজ গাছ। সড়কে বসানো হয়েছে সৌরবিদ্যুতের বাতি। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে কারখানাটিতে ২০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়।
প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের প্রধান মো. খাইরুল আলম জানান, কারখানার ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে। সেটি হলে সেখানে আরও ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। তিনি জানান, বর্তমানে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরে ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কারখানার চাহিদা মেটানো হয়।
কারখানা ঘুরিয়ে দেখাতে প্রথমেই খাইরুল আলম নিয়ে যান বর্জ্য পরিশোধনাগার প্ল্যান্টে (ইটিপি)। ডেনিম কাপড় উৎপাদনে রাসায়নিকের ব্যবহার হয়, তাই পরিবেশ সুরক্ষায় সার্বক্ষণিক ইটিপির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাইওনিয়ার ডেনিম কারখানার ইটিপিতে ছয় হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। বায়োলজিক্যাল পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে এই বর্জ্য পরিশোধন করা হয়। পরিশোধনের পর ইটিপি থেকে নির্গত পানি দিয়ে নিজেদের পুকুরে মাছ চাষ করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। আর কঠিন বর্জ্য সিলেটে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিবেশসম্মত উপায়ে ধ্বংস করা হয়।
খাইরুল আলম জানান, বর্জ্য পরিশোধনে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এতে করে পরিশোধনের পর যে পানি পাওয়া যাবে, তা পুনরায় উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যাবে।
কারখানাভেদে প্রতি কেজি ডেনিম কাপড় উৎপাদনে ৫০-৬৫ লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। তবে পাইওনিয়ার ডেনিম কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রতি কেজি কাপড় উৎপাদনে পানি লাগে ৩৯ লিটার। আর সারা বছর কারখানাতে যে পানি লাগে, তার ২০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে। এ জন্য কারখানার এক পাশে আধুনিক ট্যাংকার স্থাপন করা হয়েছে।
ইটিপি ঘুরে দেখে আমরা চলে যায় কারখানার ভেতরে। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এই কারখানায় নিজেদের স্পিনিং মিলে তৈরি সুতা ব্যবহার করা হয়। সেই সুতা প্রথমে মেশিনের মাধ্যমে স্টিলের বড় রোলে প্যাঁচানো হয়। সুতার সেই রোল বিশাল ডাইং মেশিনের মাধ্যমে রং করে তা দিয়ে কাপড় বোনা হয়। কাপড় বোনার পর ফিনিশিং করা হয়।
বিশাল এ কারখানা ঘুরে দেখতে দেখতেই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। এর মধ্যে কারখানায় এসে হাজির হন উদ্যোক্তা বাদশা মিয়া। প্রায় ৫০ বছর আগে কিশোর বয়সে সুতার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর একে একে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাদশা টেক্সটাইল, কামাল ইয়ার্ন, পাইওনিয়ার নিটওয়্যার ও পাইওনিয়ার ডেনিম নামে চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এখন বাদশা গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন ৭০ কোটি ডলারের বেশি, পুরোটাই সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানি, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা।
পাইওনিয়ার ডেনিম কারখানার ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে বাদশা মিয়া বলেন, ডেনিম কারখানার পাশেই ২০০ বিঘা জমির ওপর ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে পোশাক কারখানা নির্মাণ করছেন। ইতিমধ্যে ছোট একটা অংশ চালু হয়েছে। রপ্তানিও শুরু হয়েছে সেখানে উৎপাদিত পোশাক। এই কারখানায় ডেনিম পোশাক উৎপাদিত হবে। নতুন কারখানাটি পুরোদমে চালু হলে তাতে ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া ডেনিম কারখানার অদূরেই সুতার কল বা স্পিনিং মিলও নির্মাণ করছেন। সেখানে প্রতিদিন ২০০ টন সুতা উৎপাদিত হবে। এই সুতা ডেনিম কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করা হবে।
বাদশা মিয়া বললেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ব্যবসার খরচ বাড়ছে। এই জায়গায় সরকারকে নজর দিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আমাদের জন্য সহজ হবে।’