ডলার–সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যায় পড়ছেন উদ্যোক্তারা। আবার গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে সিমেন্টের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে প্রতি টনে শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। তাতে বাজারে দুই ধরনের সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি ৮ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বাড়বে। ফলে বাড়বে অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয়।
সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) নেতারা বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, ডলার–সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যায় পড়ছেন উদ্যোক্তারা। ফলে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটছে। আবার গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে সিমেন্টের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর দিলকুশায় হোটেল পূর্বাণীতে গতকাল সোমবার আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিসিএমএ সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্লিংকার আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে টনপ্রতি ২০০ টাকা করার অনুরোধ করেছিলাম। বাজেটে উল্টো আরও ২০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এই শিল্পের বর্তমান নানা সংকট বিবেচনায় শুল্ক কমানোর আহ্বান জানান তিনি।
প্রতি ডলার ১০৮ টাকা থেকে শুরু করে ১১৫-১১৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আগে ব্যাংকগুলো শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ নিত। এখন ব্যাংকগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ১ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নিচ্ছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু ডলার বিক্রির মুনাফা দিয়েই ব্যাংক ভালো ব্যবসা করছে।মো. আলমগীর কবির, সভাপতি, বিসিএমএ
বিসিএমএ নেতারা জানান, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর কারণে পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্টের (পিসিসি) প্রতি বস্তায় দাম বাড়বে ৮-১৫ টাকা। এ ছাড়া অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের (ওপিসি) দাম বাড়বে প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ২৫ টাকা।
দেশে বর্তমানে ৩৫টি দেশি-বিদেশি সিমেন্ট কোম্পানি আছে। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান লক্ষাধিক। দেশে সিমেন্টের চাহিদা বছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। যদিও কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৭ কোটি ৯০ লাখ টন। সেই হিসেবে উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহৃত হচ্ছে না।
বিসিএমএর নেতারা সিমেন্টের পাঁচ ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দশমিক ৫০ শতাংশ করার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা জানান, গত ১১ মাসে সিমেন্ট খাতের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের মতো কমেছে। তা ছাড়া দেশে এখন সরকারের মেগা প্রকল্পের কাজও অনেক কমে এসেছে। তাতে সিমেন্টের পাঁচটি কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর—ক্লিংকারে ২ শতাংশ; স্লাগ ও লাইমস্টোনে ৩ শতাংশ; ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসামে ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ করা হোক। আর কাঁচামাল আমদানিতে কর নিরূপণ মূল্য বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে, সেটি বন্ধ করা প্রয়োজন।
বিসিএমএ সভাপতি আলমগীর কবির বলেন, সিমেন্টের বিক্রয় পর্যায়েও ২ শতাংশ এআইটি রাখা হচ্ছে। এটা পরবর্তী সময়ে সমন্বয় করা হয় না। কাঁচামালের ওপর একবার এআইটি ও বিক্রয় পর্যায়ের আরেকবার নিলে তা দ্বৈত কর হয়। সব এআইটি কমানো ও সমন্বয় করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
ডলার–সংকটে ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতা নিয়ে আলমগীর কবির বলেন, এ কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন হচ্ছে। মুদ্রার বিনিময় হারের কারণে বস্তাপ্রতি সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০-৬০ টাকা। আগে অল্প মার্জিনে এলসি খোলা গেলেও এখন অনেক ক্ষেত্রে দিতে হচ্ছে শতভাগ। মাঝেমধ্যে এলসি খুলতে নিরুৎসাহিত করছে ব্যাংক। আবার এলসি খোলা ও বিল পরিশোধের সময় ডলারের দামের পার্থক্য হয়। শুধু এ কারণেই ব্যবসায়ীরা লোকসান করছেন।
অনেক ব্যাংক এলসিতে অতিরিক্ত কমিশন আদায় করছে অভিযোগ করে বিসিএমএ সভাপতি বলেন, প্রতি ডলার ১০৮ টাকা থেকে শুরু করে ১১৫-১১৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আগে ব্যাংকগুলো শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ নিত। এখন ব্যাংকগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ১ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নিচ্ছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু ডলার বিক্রির মুনাফা দিয়েই ব্যাংক ভালো ব্যবসা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আলমগীর কবির বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিমেন্টশিল্পকে ‘অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা করে ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ডলার–সংকটের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হোক। তাহলে এ খাতের দুরবস্থা কিছুটা হলেও কমবে।
আলমগীর কবির বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস–সংকটের কারণে নিজস্ব কেন্দ্রের মাধ্যমেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সিমেন্ট পরিবহনে খরচ বেড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের লাইটার জাহাজের ভাড়া ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করার কথা ছিল। তবে জাহাজমালিকদের সংগঠন জোরপূর্বক ২০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। এসব ব্যাপারে সরকারের নজরদারি বাড়ানো ও রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনার অনুরোধ জানান তাঁরা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ইনসি সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী (সিইও) মাহমুদ হাসান, বেঙ্গল সিমেন্টের বিক্রয় প্রধান সরোজ কুমার বড়ুয়া, আকিজ সিমেন্টের অডিট ও কমপ্লায়েন্স বিভাগের প্রধান মো. মাসুদ রানা, বসুন্ধরা সিমেন্টের বিক্রয় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও বিসিএমএর নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায়।