ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করলে মধ্য জুলাই থেকে তারকা হোটেলে ব্যবসা বড় ধাক্কা খায়। তারপর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-পরবর্তী সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বিলাসবহুল হোটেলগুলো প্রায় অতিথিশূন্য হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুষ্ঠান ও করপোরেট আয়োজন কমে যাওয়ায় বড় লোকসানে পড়ে এসব হোটেল।
গত আড়াই মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় তারকা হোটেলের ব্যবসা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এখনো আগস্টের ধাক্কা কাটিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি ব্যবসা। চলতি মাসেও রাজধানীর অধিকাংশ তারকা হোটেলের ৫০ শতাংশ বা তার বেশি কক্ষ ফাঁকা থাকছে। বিয়েশাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠান সেভাবে হচ্ছে না। সভা-সেমিনার হলেও গত বছরের তুলনায় অনেক কম।
একাধিক তারকা হোটেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তারকা হোটেলের অতিথিদের বড় অংশই দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশি অতিথির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে কিছুটা স্থবিরতা থাকায় ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে বিদেশি অতিথিরা আসছেন কম। আবার দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন, তাঁদের উপস্থিতিও কমে গেছে। তবে নভেম্বরে ব্যবসা কিছুটা বাড়তে পারে বলে আশা তাঁদের।
করোনার আগের বছর ঢাকার গুলশানে পাঁচ তারকা মানের হোটেল রেনেসাঁর কার্যক্রম শুরু হয়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক হোটেল ব্র্যান্ড ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের রেনেসাঁ বাংলাদেশে যাত্রা করে। হোটেলের নাম ‘রেনেসাঁ ঢাকা গুলশান হোটেল’। গুলশানে ১৯ তলা এ হোটেলে কক্ষ রয়েছে ২১১টি কক্ষ।
জানতে চাইলে রেনেসাঁ হোটেলের ব্যবস্থাপক আল আমিন বলেন, ‘গত আগস্টে হোটেলের ব্যবসা ১৫ শতাংশে নেমেছিল। সেখান থেকে সেপ্টেম্বরে ব্যবসা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত গড়ে ৪০ শতাংশ কক্ষ বুকিং থাকছে।’ তিনি জানান, হোটেলের অতিথির ৮০ শতাংশই ব্যবসায়ী। বাকি ২০ শতাংশ এয়ারলাইনস, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিদেশি কর্মকর্তা বা পরামর্শক এবং স্থানীয় বিত্তশালী। স্বাভাবিক সময়ে ৭০-৭৫ শতাংশ কক্ষ বুকিং থাকে হোটেলটির।
নভেম্বরে ব্যবসা আরেকটু বাড়বে বলে আশা আল আমিনের। তিনি বলেন, ‘আমাদের অতিথিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা শীর্ষ দশে আছেন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে আসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।’
খাতসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকার বিমানবন্দরের সবচেয়ে কাছের লে মেরিডিয়ান হোটেল ব্যবসাও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। গত মধ্য জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত ব্যবসার ক্ষেত্রে কঠিন সময় পার করেছে এই পাঁচ তারকা হোটেলটি। সেপ্টেম্বর থেকে আবার ব্যবসা বাড়তে থাকে। সাধারণত এই হোটেলের ৬০ শতাংশ কক্ষ ব্যবসায়ীরা ও ৪০ শতাংশ কক্ষ এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য বুক করে। চলতি মাসে ৪০-৪৫ শতাংশ কক্ষ বুকিং থাকছে। তার বড় অংশই এয়ারলাইনসের হাত ধরে হচ্ছে।
সরকারি মালিকানাধীন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ২৭৮টি কক্ষ রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এই হোটেলের ৫০-৬০ শতাংশ কক্ষে নিয়মিত অতিথি থাকেন। তবে হোটেলটি শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় সভা-সেমিনার বেশি হয়। গত জুলাই-আগস্টে সভা-সেমিনারের আয়োজন কম হলেও সেপ্টেম্বর থেকে কিছুটা বাড়তে শুরু করে। রেস্তোরাঁয় গ্রাহকদের ভিড় একটু একটু করে বাড়ছে।
সোনারগাঁও হোটেলের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাফেউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত আগস্টে আমাদের হোটেলের কক্ষ বুকিংয়ের হার ২০-২৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। গত মাস থেকে আবার বুকিং বাড়তে শুরু করেছে। চলতি মাসে হোটেলের কক্ষ বুকিং ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।’
ঢাকার শাহবাগে প্রায় সাড়ে ৪ একর জমির ওপর অবস্থিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল নতুন রূপে ফেরে ২০১৮ সালে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও হোটেলটি চালু ছিল। সে সময় হোটেলটি ছিল ‘নিরাপদ এলাকা’। বর্তমানে ইন্টারকন্টিনেন্টালে কক্ষ আছে ২২৪টি। বছরের এই সময়ে সাধারণত ৭২-৭৫ শতাংশ কক্ষ বুকিং থাকে। তবে এখন ৩০-৩৫ শতাংশ কক্ষে অতিথি আছেন। যদিও এই পরিস্থিতি গত দুই মাসের তুলনায় অনেক ভালো। আগস্টে কক্ষ বুকিং ১০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের একজন কর্মকর্তা বলেন, বছরের শেষ প্রান্তিকে ঢাকার তারকা হোটেলগুলোর ব্যবসা বেশি হয়। এবার পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। জুলাই-আগস্টের তুলনায় ব্যবসা কিছুটা বাড়লেও তা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে খুবই কম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি শিল্পকারখানায় শ্রম অসন্তোষ, সরকারি প্রকল্পের কাজে ধীরগতি, নতুন প্রকল্প না নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে হোটেলে অতিথির সংখ্যা বাড়ছে না।
রাজধানীর গুলশানের আরেক তারকা হোটেল ওয়েস্টিন। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের আওতাধীন একটি হোটেল। এ ছাড়া বনানীর শেরাটন হোটেলও এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। অন্য হোটেলগুলোর মতো ওয়েস্টিন ও শেরাটন হোটেলের ব্যবসাও ধুঁকছে তিন-চার মাস ধরে।
জানতে চাইলে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের (ওয়েস্টিন) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত জুলাই মাসে আন্দোলন চলাকালে আমাদের হোটেলের কক্ষ বুকিং বা অতিথি উপস্থিতি ধারণক্ষমতার ১০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। আগস্টে তা ছিল ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে। অক্টোবর মাসে এসে অতিথি উপস্থিতি বেড়ে ধারণক্ষমতার তুলনায় ৩০-৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর ফলে জুলাই-আগস্টে প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালন লোকসান গুনতে হয়। সেপ্টেম্বরের ব্যবসা ছিল না লাভ, না লোকসানের পর্যায়ে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, তাঁদের হোটেলের অতিথিদের ৯৮ শতাংশই বিদেশি। জুলাই থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশি অতিথি কমে যাওয়ায় তাঁদের ব্যবসায় বড় ধরনের ধাক্কা লাগে।