নতুন মজুরিকাঠামোতে সাতটি গ্রেডের বদলে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। নতুন মজুরি কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর থেকে।
পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে মালিকপক্ষের দেওয়া নতুন প্রস্তাবকেই গ্রহণ করা হয়েছে। নিম্নতম মজুরি বোর্ডে এক ঘণ্টার বৈঠকে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিও তা মেনে নেন। ফলে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বেড়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা হতে চলেছে। বর্তমানের চেয়ে এই মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। বর্তমানে দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের এই শিল্পে নিম্নতম শ্রমিক মজুরি ৮ হাজার টাকা।
চূড়ান্ত হওয়া মজুরি প্রস্তাব অনুযায়ী, মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৬ হাজার ৭০০ টাকা। আর মূল বেতনের অর্ধেক হচ্ছে বাড়িভাড়া। এ ছাড়া খাদ্যভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা, চিকিৎসাভাতা ৭৫০ টাকা ও যাতায়াতভাতা ৪৫০ টাকা। প্রতিবছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়বে। নতুন মজুরিকাঠামোতে সাতটি গ্রেডের বদলে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। আগামী ১ ডিসেম্বর নতুন মজুরি কার্যকর হবে এবং জানুয়ারি মাসে নতুন কাঠামো অনুযায়ী মজুরি পাবেন শ্রমিকেরা।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় গতকাল মঙ্গলবার রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরিকাঠামোর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। বেলা সাড়ে তিনটার পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা, বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান প্রমুখ।
মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই পোশাকশ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা করছি। এটা ঠিক, শিল্প বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে। তাই শ্রমিকদের বলব, আপনারা কাজে যোগ দিন। আর মালিকদের বলব আপনারা কারখানা খুলে দিন।’ মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে ও অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে শ্রমিকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন—এমন মন্তব্য করে শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কারও উসকানিতে কান দিয়ে বিপদ বাড়াবেন না।’
শ্রম প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, পোশাকশ্রমিকদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা যাই হোক না কেন প্রত্যেক শ্রমিককে একটি করে ফ্যামেলি কার্ড দেওয়া হবে। পরবর্তীতে তাদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হবে।
মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের পর পোশাকশ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করা হলো। তবে চূড়ান্ত মজুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তা পুনর্বিবেচনার দাবি করেছে ১১টি শ্রমিক সংগঠনের জোট ‘মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলন’। তাদের বক্তব্য, বোর্ডের প্রস্তাব শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। শ্রমিকনেতাদের কেউ কেউ গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণে সরকারপ্রধানের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, এই মজুরি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ২০১৮ সালে নিম্নতম মজুরি ছিল ৯৫ ডলার। এখন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা ধরলেও নতুন মজুরি দাঁড়ায় ১১৩ ডলার। তাহলে পাঁচ বছর পর এসে মজুরি বাড়ল মাত্র ১৮ ডলার। এটাকে কি মজুরি বৃদ্ধি বলে?
নাজমা আক্তার আরও বলেন, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম ৫০-৬০ টাকা, পেঁয়াজ ১০০-১৪০ টাকা আর সয়াবিন তেল কিনতে হচ্ছে ১৬৯ টাকা লিটার। যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা দিয়ে শ্রমিকেরা এই বাজারে চলতে পারবেন না। মজুরি পুনর্বিবেচনা করা হোক। মজুরি নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন হলে তার দায় সরকার, মজুরি বোর্ড ও মালিকপক্ষকে নিতে হবে।
তবে নতুন মজুরি নিয়ে কয়েকজন শ্রমিকনেতা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য গত এপ্রিলে সরকার নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে। গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ প্রায় অর্ধেক বা ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেয়। মালিকদের এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকেরা পরদিন আন্দোলনে নামেন। গাজীপুরে শুরু হওয়া আন্দোলন পরে রাজধানীর মিরপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় ছড়ায়। আন্দোলনের সময় দুজন শ্রমিকও মারা যান। আন্দোলনের মুখে ১ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভায় মালিকপক্ষ নতুন করে প্রস্তাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
সেগুনবাগিচায় নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে গতকালের সভা ১১টায় শুরু হওয়ার কথা ছিল। চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা যথাসময়ে এলেও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম আসেন দুপুর ১২টায়। এর ১০ মিনিট পর আসেন মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান। এরপর এক ঘণ্টার আলোচনায় মজুরি চূড়ান্ত হয়ে যায়।
জানা যায়, সভায় মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ১২ হাজার ৫০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেয়। শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি আলোচনার এক পর্যায়ে ১৩ হাজার টাকা দাবি করেন। তবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান মালিকপক্ষের প্রতিনিধি। এরপর শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি আপত্তি তোলেননি।
সাড়ে ১২ হাজার টাকার মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার পেছনে কী যুক্তি কাজ করেছে তা জানতে চাইলে গত রাতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা এই প্রস্তাব দিয়েছি।’
অন্যদিকে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকের আলোচনায় প্রথমে আমি ১৫ হাজার টাকা দাবি করেছিলাম। একপর্যায়ে ১৩ হাজার টাকাও বলেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ১৩ হাজার টাকা হলেও খুশি হতাম।’
পরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা বলেন, ‘মালিক ও শ্রমিক, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই একটা গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের প্রত্যাশাও ১২ হাজার ৫০০ থেকে ১৩ হাজার টাকার মধ্যেই ছিল। আমরা মাঝামাঝি পর্যায়ের একটা কিছু করেছি এবং তা প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতেই করেছি।’
১৯৯৪ সালে প্রথম মজুরি বোর্ডে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত হয় ৯৩০ টাকা। তারপর ২০০৬ ও ২০১০ সালে মজুরি বাড়ে। ২০১৩ সালে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়। ২০১৮ সালে মজুরি বাড়ানো হয় ৫১ শতাংশ। তখন নিম্নতম মজুরি দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকায়।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সভাপতি আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ প্রত্যাশা ছিল, ১৩ হাজার টাকার ওপরে মজুরি হবে। মালিকেরা যখন আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তখন আমরা বলেছিলাম ১৩ হাজারের নিচে নাইমেন না। আমি মনে করি, মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকবে। প্রধানমন্ত্রী যদি হস্তক্ষেপ করেন, তাহলে এই মজুরি আরেকটু ভালো জায়গায় যাবে। গ্রহণযোগ্য হবে।’
গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কোনাবাড়ী ও কাশিমপুর এলাকায় গতকাল সকালে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে পোশাকশ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছেন। এ সময় তাঁরা দুটি যাত্রীবাহী বাস পুড়িয়ে দেন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শিল্প পুলিশের সূত্র জানায়, মজুরি বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হলে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের বেশ কয়েকবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। সকাল ১০টার দিকে কোনাবাড়ী এলাকায় যাত্রীবাহী দুটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেন উত্তেজিত শ্রমিকেরা। এ ছাড়া তাঁরা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করেন। শ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের একাধিক দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে আসে। দুপুরের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা যেন আর কোনো সহিংসতা করতে না পারেন, সে জন্য সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বা বাজারদর বিবেচনা করলে নতুন মজুরি শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। আমরা শঙ্কার মধ্যে আছি, শ্রমিকেরা এই মজুরি মানবে কি না। ইতিমধ্যে আমরা শ্রমিকদের কাছ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি।’