দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন মানসম্মত টাইলস দেশেই তৈরি করছে। আকিজ সিরামিকস লিমিটেডের বনানী বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ছবি তুলেছেন খালেদ সরকার
দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন মানসম্মত টাইলস দেশেই তৈরি করছে। আকিজ সিরামিকস লিমিটেডের বনানী বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ছবি তুলেছেন খালেদ সরকার

দেশে টাইলসের চাহিদা বাড়ছে, বড় হচ্ছে বাজার

রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় একটি টাইলস বিক্রির দোকানে পছন্দের টাইলস কিনছিলেন আবুল কাশেম। দুই ছেলে–মেয়ে, সবাই তাঁদের পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। মুন্সিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে ঈদের ছুটিতে ছেলে–মেয়েরা বিদেশ থেকে আসবেন। এ জন্য নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেই বাড়ি তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। আর এখন টাইলস লাগানোর পালা। তাই ছেলে–মেয়েদের কাছে বিভিন্ন টাইলসের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে মতামত নিচ্ছেন কোনটি কিনবেন। আবুল কাশেম বলেন, ‘ছেলে–মেয়েরা ঢাকায় এলে ভাড়া বাসায় আসে। আবার ছোট বাসা হওয়ার সবাই একসঙ্গে থাকাও যায় না। তাই গ্রামের বাড়িটা বড় করছি। সেখানে কয়েক দিন সবাই থাকব। বাসার কাজ শেষ দিকে, তাই টাইলস কিনতে এসেছি। পছন্দ হলেই কিনে নিয়ে যাব। দেখি ছেলে–মেয়েরা কোনটি পছন্দ করে।’

আবুল কাশেমের মতো অনেকেই এসেছেন হাতিরপুল এলাকায় পছন্দের টাইলস কিনতে। দোকানগুলোতে ভিড়ও বেশি। তাঁদের বেশির ভাগই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তবে ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন। এমনই একজন চন্দন সরকার। রাজশাহী থেকে এসেছেন তিনি কিছুটা ভালো মানের টাইলস কিনতে। বলছিলেন, ‘রাজশাহীর বাজারে ঘুরেছি, পছন্দ হয়নি। ঢাকা থেকে কিনে ট্রেনে এগুলো নিয়ে যাব।’ তিনিও বাসা বানাচ্ছেন শহরে। পছন্দের টাইলস কিনে দ্রুত বাড়িতে লাগানোর পরিকল্পনা তাঁর।

দেশে কয়েক বছরে দ্রুত বর্ধনশীন খাতগুলোর একটি সিরামিকশিল্প। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। রুচিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশীয় উদ্যোক্তারা সিরামিক খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করছেন। এতে দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন মানসম্মত টাইলস দেশেই তৈরি করছে। তাতে সব মিলিয়ে প্রতিবছর দেশের সিরামিক পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেড় দশক আগেও দেশের টাইলসের বাজার ছিল আমদানিনির্ভর। তবে সেই চিত্র বদলেছে। এখন বাংলাদেশের টাইলসের বাজার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

বর্তমানে টাইলসের বাজারে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অংশীদারত্ব প্রায় ৮৬ শতাংশ। দেড় দশক আগেও এ বাজার ছিল আমদানিনির্ভর। অর্থাৎ দেশে যত টাইলস বিক্রি হয়, তার ৮৬ শতাংশই দেশি কোম্পানির তৈরি। ফলে গ্রাহকেরাও দেশীয় টাইলস পণ্য কিনতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।

বাংলাদেশ সিরামিক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সিরামিকের উপখাত হচ্ছে তিনটি—তৈজসপত্র, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার। এসব পণ্য উৎপাদনে ৭৪টি কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে ৩১টি টাইলস, ২০টি টেবিলওয়্যার ও ১৯টি স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদনের কারখানা।

বিসিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, দেশে সিরামিক পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ১৭ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে বিক্রির দিক থেকে সবচেয়ে বড় বাজার টাইলসের। গত অর্থবছরে ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার টাইলস বিক্রি হয়। এর মধ্যে দেশীয় কোম্পানির হিস্যা ছিল ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার।

জানা গেছে, দেশীয় সিরামিকস তথা টাইলসশিল্পে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেন। এর মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। খাতটিতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশীয় কোম্পানিগুলো বছরে ২১ কোটি বর্গমিটার টাইলস উৎপাদন করতে পারছে। উৎপাদন সক্ষমতা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

প্রায় সাড়ে ছয় দশক আগে এ ভূখণ্ডে সিরামিক পণ্যের উৎপাদন শুরু হয়। তবে টাইলসের যাত্রাটা শুরু হয় আরও পরে। ১৯৯৩ সালে মধুমতি সিরামিকস দেশে প্রথম টাইলস কারখানা স্থাপন করে। তারপর গত তিন দশকে একে একে বাজারে আসে আরএকে, সিবিসি, মীর, গ্রেটওয়াল, আকিজ, স্টার, ডিবিএল, শেলটেক, ফ্রেশ, তুষার, বিএইচএলসহ বেশ কিছু কোম্পানি।

সিরামিক খাতের বেশির ভাগ বিনিয়োগ এসেছে ২০০০ সালের পর, অর্থাৎ গত ২২ বছরে। এ খাতের কারখানাগুলোর মধ্যে ৬০টিই গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত। এদের বেশির ভাগ কারখানা ইউরোপীয় ও জাপানি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে গুণগত দিক দিয়ে ভালো মানের পণ্য তৈরি করতে পারছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তবে দেশে সিরামিকের বাজার বৃদ্ধির পেছনে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতি সহায়তাও সহায়ক ছিল বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।