নতুন জরিপ

৪২ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র

কাজের অপেক্ষায় বসে আছেন শ্রমিকেরা। রাজশাহী নগরের কামরুজ্জামান চত্বরে
ফাইল ছবি

করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। দেশব্যাপী খানা পর্যায়ের জরিপের ভিত্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। নিজেদের অর্থায়নে এই জরিপ পরিচালনা করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম।

বিবিএসের খানা জরিপ অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর করোনার সময়ে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে আজ এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

দারিদ্র্য যে বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা ও চিকিৎসায়ও এর প্রভাব দেখা যায়, এই প্রথম এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলল।
জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

জরিপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, ২০২০ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীয় আয়ের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যক্তিক পর্যায়ে তা বরং কমে গেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, অনানুষ্ঠানিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী আয় এসেছে। এতে বিনিময় হার কমে গেছে। ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পরিবার বলেছে, দেশের বাইরে থেকে আসা প্রবাসী আয় কমেছে। একই ক্ষেত্রে আগের মতো আছে বলেছে ১৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবার। ফলে প্রবাসী আয়ের প্রভাব সমাজে অতটা অনুভূত হয়নি, যতটা বলা হয়েছে, সে তুলনায়।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, জরিপ পরিচালনার খরচ আছে। তবে তহবিল পাওয়া না গেলেও সানেম নিজস্ব অর্থায়নে জরিপটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘এটা না হলে আমরা একটি পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে ফেলতাম।’ সেই তাড়না থেকেই এই জরিপ। দারিদ্র্য, অসমতা ও কর্মসংস্থান—এই তিনটি ক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাব নিরূপণ করা হয়েছে বলে জানান সেলিম রায়হান।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের কারণে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। আবার জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ পরিবার বলেছে, তারা খাপ খাওয়ানোর পথই খুঁজে পায়নি।

২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬.৪%, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪.৫%। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৩%।

আর এই দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে অসমতায়। ভোগের ক্ষেত্র জিনি সহগ দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩। অথচ ২০১৮ সালে সানেম ও জিইডির আরেক জরিপে দেখা গিয়েছিল, এর মান শূন্য দশমিক ৩১। ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২।

দারিদ্র্যের আরেকটি ফল হলো, শিক্ষাগ্রহণ ব্যাহত হওয়া। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষাব্যয় কমেছে। অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য এই হার হ্রাস সবচেয়ে বেশি—৫৮ শতাংশ। পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও কম।

জরিপের ফলাফল নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় সাধারণত ভোগ দিয়ে। কিন্তু দারিদ্র্য যে বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা ও চিকিৎসায়ও এর প্রভাব দেখা যায়, সানেমের জরিপ এই প্রথম এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিচ্ছে। শিক্ষাদারিদ্র্য বেড়েছে, শিক্ষায় ব্যয় কমেছে, বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থায় বেশির ভাগই অংশ নিতে পারছে না—এমনকি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা আগের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় কতটা কম কার্যকর, সেটিও জানতে পারলে আরও ভালো হতো বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন।

২০২০ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীয় আয়ের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যক্তিক পর্যায়ে তা বরং কমে গেছে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্য যেভাবে পরিমাপ করা হয়, খাদ্য ও অন্যান্য ভোগের তথ্য যেভাবে আলাদা পদ্ধতিতে সারা বছর ধরে সংগ্রহ করা হয়, সানেমের জরিপে সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি। সে জন্য তিনি মনে করেন, এই দুই জরিপের তথ্য তুলনা করা ঠিক নয়।

কোভিডের প্রভাবে খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমে গেছে, কোন খাতে কতটুকু কমেছে, সেই অনুপাত জানা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ। দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় আনতে শিক্ষা খাত যত দ্রুত সম্ভব চালু করতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে ভর্তুকি দিতে হবে, কর্মসংস্থানের পরিবর্তনগুলো স্বীকার করে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে তিনি মত দেন।

বিশালসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ তারা দরিদ্র না হয়েও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছেন। অর্থাৎ শুধু মাথা গোনার হিসাব থেকে বেরিয়ে এসে ঝুঁকিপূর্ণ অ-দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পুনরুদ্ধারের আশা আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর জন্য তা এখনো চ্যালেঞ্জিং।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।