ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার

হাতের কাজে বিশ্বজয়

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একঝাঁক এসএমই উদ্যোক্তা আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে চলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চোখের সামনে কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও ভেঙে পড়েন না, কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদে নিঃস্ব হলেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেন, কেউ কেউ সোনালি আঁশের নবজাগরণের জন্য কাজ করেন। এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ ছয়জন স্বপ্নজয়ী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে ‘আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১’। তাঁদের মধ্যে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার

বিশেষ শ্রেনীতে আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১ বিজয়ী ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

প্রকৌশলী ও চিকিৎসক পরিবারের সন্তান রেহানা আক্তার সবাইকে চমকে দিয়ে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন, সেদিনও তিনি জানতেন না তিনি জীবনের এক বাঁকে হাজির হয়েছেন। ১৯৯৩ সালে এইচএসসির পর একটা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হলেও সেটার ক্লাস শুরু হতে দেরি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ও ঘ ইউনিটের অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তির সুযোগ হবে না মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষা দেন। আঁকাআঁকি একটু-আধটু ভালো লাগত বলে একই দিনে ডেন্টালের ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে চারুকলায় পরীক্ষা দেওয়া। মৌখিক পরীক্ষার সময় ইনস্টিটিউটে মাটি আর সিরামিকের কাজ দেখে আগ্রহী হন। বড় বোন বললেন, ‘পেইন্টিং না পেলে ক্রাফটিং নিয়ো তাহলে নিজে একটা কিছু করতে পারবে’। ক্লাস শুরু হতে না হতে রেহানা প্রেমে পড়ে গেলেন মৃৎশিল্পের। এবং সেটার প্রমাণও দিয়ে দিলেন শুরুতে।

চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিবছর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে সিনিয়রদের হারিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন রেহানা। শিক্ষকেরাও উৎসাহ দেন তাঁদের প্রিয় শিক্ষার্থীকে। প্রথমে নিজেদের বাসার সিঁড়ির নিচের ছোট্ট জায়গায় একটা স্টুডিও বানান। কাজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উঠে আসেন বাসার চিলেকোঠায়। একটু একটু করে যন্ত্রপাতি জোগাড়ে নামেন। পুঁজি সংগ্রহের জন্য সপ্তাহে এক দিন বুটিক হাউসে কাজ নেন আর বাসার বারান্দায় দুই শিশু শিক্ষার্থীকে ড্রয়িং শেখাতে শুরু করেন। রেহানার আগে সবাই হ্যান্ডমেড সিরামিকের শোপিস বানানোতে সীমাবদ্ধ থাকতেন। শিল্পী যেমন তুলির আঁচড়ে তাঁর শিল্পকে মানুষের কাছে নিয়ে যান তেমনি রেহানা আক্তারও মাটির ওপরে তাঁর শিল্পকর্মকে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারে পৌঁছে দিতে চান। এতে দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্রেও নিজের রুচি ও আধুনিকতার মিশেলে রেহানা শোকেসের ধারণাকে দৈনন্দিন ব্যবহারে নিয়ে আসলেন। শোপিসের বদলে টেবিল ওয়্যার বানাতে শুরু করলেন।

অতিথিদের সঙ্গে এসএমই পুরস্কার ২০২১ পাওয়া বিজয়ীরা। (বসা, বাঁ থেকে) মো. ওলি উল্লাহ, রেহানা আক্তার, ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, রাজিয়া সুলতানা, মো. মনির হোসেন ও কামরুন্নাহার খানম। (দাঁড়িয়ে, বাঁ থেকে) মো. জাকের হোসেন, মির্জা নূরুল গণী, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, এম জামাল উদ্দিন, মুহম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমান ও মতিউর রহমান। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

সে সময় তাঁর কোনো চুল্লি ছিল না। কাজ গুছিয়ে রায়েরবাজার থেকে পুড়িয়ে আনতেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের একটি মেলাতে যোগ দেন। তিন দিনের মেলার জন্য যা সামগ্রী তৈরি করেন সব কটিই বিক্রি হয়ে যায় প্রথম দিন। বুঝতে পারেন চাহিদা আছে। নিজের প্রতিষ্ঠানকে বড় করা যায়।

এর মধ্যে পড়া শেষ হয়। একটা চাকরিও জুটে যায় একটি বিখ্যাত সিরামিক কোম্পানিতে। কিন্তু সিরামিক কারখানা ঢাকা থেকে দূরে হওয়ায় বাবা তাঁকে চাকরি করতে নিষেধ করেন। কিন্তু রেহানার মনে সিরামিক নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে ও স্বপ্ন লালিত হতে থাকে।

আর এরপরই ক্লে ইমেজকে বড় করতে নামেন রেহানা। পরিবারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সহায়তা দেওয়া হয়। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে বাবার একটা জায়গাতে টিনশেডের একটি ঘরে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দেন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন। এটি ২০০২ সালের ঘটনা।

এখন তাঁর সেই একচালা টিনশেডের জায়গাতে তিনতলা কারখানা। রয়েছে নিজের চুল্লি। কাজ করেন ৭০ জন কর্মী। তাঁর পণ্যের বড় চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যাত্রাপথে চারুকলায় তাঁর শিক্ষক সায়ীদ তালুকদার, মরণ চাঁদ পাল ও স্বপন শিকদারের কথা স্মরণ করেন।

রেহানার কারখানার নির্মাণকর্মীদের সবাই নারী। কোনো কোনো কর্মী তাঁর সঙ্গে আছেন ১৫ বছর ধরে। বিয়ের পর নবদম্পতিদের জন্য অস্থায়ী ডেরার জন্য একটি ডরমিটরি বানিয়ে নিয়েছেন। সেখানে থেকে পরে নিজেদের ঠিকানায় উঠে পড়ে সবাই। কারখানায় কর্মীদের শিশুসন্তানদের দেখভালের ব্যবস্থাও করেছেন।

এখন তাঁর বানানো তৈজসপত্র চলে যাচ্ছে বিশ্বের ৩০টি দেশে। কানাডার টরন্টোর একটি গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই রেহানার ক্লে ইমেজের তৈজস রয়েছে।

সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে পেয়েছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার।

তাঁর পণ্যের যত চাহিদা তার বড় অংশই মেটাতে পারেন না। তাই ৫ বিঘা জমিতে নিজের কারখানা সম্প্রসারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন রেহানা। সেখানে কাজের বড় অংশ হাতেই করবেন দক্ষ কর্মীরা। কিন্তু যন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয়করণের মাধ্যমে উৎপাদনক্ষমতা বাড়বে কয়েক গুণ। ধানমন্ডি ও মিরপুরের শোরুম ছাপিয়ে নিজের পণ্যকে পৌঁছে দিতে চান আরও বৃহত্তর পরিসরে।

সেই কাজে মনোনিবেশ করেছেন ক্লে ইমেজের উদ্যোক্তা রেহানা আক্তার।