জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ

শ্রমিক থেকে নিজের কৃষিযন্ত্রের কারখানা

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একঝাঁক এসএমই উদ্যোক্তা আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে চলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চোখের সামনে কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও ভেঙে পড়েন না, কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদে নিঃস্ব হলেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেন, কেউ কেউ সোনালি আঁশের নবজাগরণের জন্য কাজ করেন। এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ ছয়জন স্বপ্নজয়ী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে ‘আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১’। তাঁদের মধ্যে উৎপাদন শিল্পে পুরস্কার পেয়েছেন জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ

উৎপাদন শিল্পে আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১ বিজয়ী জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ
ছবি: প্রথম আলো

মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা কলিমউল্লাহর অকালমৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন কিশোর মো. ওলি উল্লাহ। অভাবের সংসার, চরম প্রতিকূলতায় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ওলি উল্লাহ গরু চরানো ও কামলার কাজ বেছে নেন। জীবিকার সন্ধানে ১৯৮৮ সালে ১৮ বছর বয়সী ওলি উল্লাহ কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে ছুটে আসেন চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জে। পরিচিত এক মামার সহযোগিতায় এই বাজারের ইসলাম মিস্ত্রির কাছে আশ্রয় পান। টানা তিন বছর নিখরচায় থাকা ও খাওয়ার শর্তে ইসলাম মিস্ত্রির ওয়ার্কশপে (লেদের দোকান) কাজ শুরু করেন। দিন দিন দক্ষ শ্রমিক হয়ে ওঠেন।

দক্ষ শ্রমিক হয়েও ওলি উল্লাহ ১৯৯১ সালে প্রথম বেতন পেয়েছিলেন ৩০০ টাকা। অথচ তাঁর কোম্পানিতে এখন ৮ থেকে ৩৫ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী আছেন। এককালের শ্রমিক ওলি উল্লাহর খ্যাতি এখন দেশজুড়ে। কৃষিযন্ত্রের কারিগর হিসেবে দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি। বর্তমানে তিনি তিনটি কারখানার মালিক। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে এসব কারখানায় ৬৩ কোটি ৫৩ লাখ ৭৩৮ টাকা মূল্যের যন্ত্র উৎপাদন করে বিক্রি করেছেন। এ সময় খরচ বাদে নিট লাভ করেছেন ৩ কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টাকা।

ওলি উল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তাঁর কারখানায় অন্তত ৬০ জন শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন। ১৯৯২ সালে ওস্তাদ ইসলাম উদ্দিন, স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী ও স্বজনদের সহযোগিতায় জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আলাদা ওয়ার্কশপ খোলেন ওলি উল্লাহ। শুরুর দিকে গরুর লাঙলের বাতিল ফলা দিয়ে নতুন ফলা এবং ধানমাড়াইয়ের যন্ত্র প্যাডেল থ্র্যাশার তৈরি করেন। ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের ট্রলি, সিডার, বেডপ্লান্টারসহ বিভিন্ন যন্ত্র সংযোজন শুরু করেন। জনতার সর্বশেষ সংযোজন কম্বাইন হারভেস্টার।

২০১০ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বারি) সঙ্গে ওলি উল্লাহর পরিচয় ঘটে। ইউএসএআইডির অর্থায়নে সামিট বাংলাদেশ, এর সহযোগিতায় এবং সিশা-বিডি প্রকল্পের আওতায় কৃষকের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে কাজ শুরু হয়। সে সময়ে বারির গবেষক দল (আইয়ুব হোসেন, এরশাদুল হক ও নুরুল আমিন) অনলাইন ও অফলাইনে সরাসরি এসে ডিজাইন, ড্রয়িংসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেন। জনতার কর্মীদের গাজীপুরে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সহযোগিতা করেন। সেখানে মান উন্নয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ, যা বাণিজ্যিকীকরণের পাশাপাশি আধুনিকায়নেও ভূমিকা রাখে।

আইডিএলসি প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১-প্রাপ্ত বিজয়ীরা অতিথিদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেয়। (বা থেকে বসা) পুরস্কারপ্রাপ্ত মো. ওলি উল্লাহ, রেহানা আক্তার, খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, রাজিয়া সুলতানা, মো. মনির হোসেন ও কামরুন্নাহার খানম। (বাঁ থেকে দাঁড়িয়ে) মো. জাকের হোসেন, মির্জা নূরুল গণী শোভন, এম এ মান্নান, এম জামাল উদ্দিন, মুহম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমান ও মতিউর রহমান। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

ওলি উল্লাহ বলেন, ‘এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রথম আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানিতে আমি একটা যোগ্য ওস্তাদ পেয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত, অভিভাবকের দিকনির্দেশনা। পাশাপাশি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইউএসএআইডি, সামিট বাংলাদেশ ও আইডি বাংলাদেশ আমাদের এ কাজে উৎসাহ দিচ্ছে এবং জাতীয়ভাবে পরিচয় পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করছে। সর্বোপরি ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় অন্য বাংলাদেশ কলামে প্রকাশিত ‘কৃষিযন্ত্রের কারিগর’ শীর্ষক প্রতিবেদন বড় অবদান রেখেছে।

বর্তমানে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী মৌসুমভিত্তিক প্রায় ৪০টি যন্ত্র তৈরি করা হয়। সিডার, বেডপ্লান্টার, আলু তোলা, ভুট্টামাড়াই, ধান-গমমাড়াই, বিভিন্ন রকম স্প্রে, বাগান পরিচর্যায় আগাছা দমনের জন্য মিনি টিলার, পাশাপাশি গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির খামারের যন্ত্র, মাছের খামারের যন্ত্র আছে। নতুন উদ্যোক্তারা গুরুত্বের সঙ্গে জনতার মেশিনগুলো কিনছেন এবং উপকৃত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠা বারি জনতাকে ভুট্টামাড়াই যন্ত্রের একটা মডেল দিয়েছে। কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী সেটি তৈরি করছেন এবং সেটি জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) একটি চপার মেশিন তৈরি করে দিয়েছে। যেটা ব্রি-চপার নামে পরিচিত। কিন্তু তখন ১ অশ্বশক্তিকে চলত,এখন ৩ অশ্বশক্তিতে চলে। আগে যেখানে ৫-৬টি গরুর জন্য ঘাস কাটত,এখন সেখানে ১০০-১৫০ গরু থাকলেও ঘাস কাটতে পারে। জনতা চপার নামেই পরিচিত। মাছের খাবার তৈরির জন্য ছোট ছোট মেশিন তৈরি করা হচ্ছে। বিস্কুট বেকারির কিছু মেশিন তৈরি করা হচ্ছে। বেকারিতে ময়দা মেশানো, কেকের খামির করার জন্য, চানাচুর তৈরি করার জন্য আমরা এগুলো তৈরি করি, যার সুপরিচিতি আছে। নতুন যাঁরা ফলবাগান করছেন। বাগান বেড়া দিয়ে সাধারণত ঘিরতে হয়। যেটা আগে মানুষ বাঁশের চটা বা জাল দিয়ে ঘিরতেন। এখন তারের বেড়া তৈরি করা একটি মেশিন কৃষকদের দিচ্ছি।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কম্বাইন হারভেস্টার (একই সঙ্গে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দীর যন্ত্র) করতে হলে ভালো অবকাঠামো এবং অ্যাকসেসরিজ (যন্ত্রাংশ) উৎপাদনের দক্ষতা লাগবে। সেগুলো আমাদের দেশে বর্তমানে বিদ্যমান নেই। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান মিলে কম্বাইন হারভেস্টার তৈরি করতে পারি, তাহলে দেশে তৈরি উন্নত মানের কম্বাইন হারভেস্টার ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকায় সরবরাহ করা সম্ভব। যেখানে আমদানি করা কম্বাইন হারভেস্টারের দাম ৩০ লাখ টাকা। ওলি উল্লাহ বলেন, সরকার যদি দেশে তৈরি কম্বাইন হারভেস্টার ভর্তুকির আওতায় আনেন,তাহলে কৃষকেরা অর্ধেক দামে তা কিনতে পারবেন।

আমাদের তৈরি ভুট্টামাড়াই মেশিন, ধান-গমমাড়াই মেশিন ইতিমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সরকারি ভর্তুকির আওতায় এসেছে।

ওলি উল্লাহ জানান, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত বেকারদের কাজে লাগানোর জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটা হলো একটি ট্রেনিং কমপ্লেক্স তৈরি করা। যেখানে ডিপ্লোমা পাস করা বেকারদের প্র্যাকটিক্যাল কাজ শেখানো এবং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। পাশাপাশি যাঁদের দক্ষ শ্রমিক দরকার, তাঁদের জোগান দেওয়া। আমার এখানে বর্তমানে তিনটি কারখানায় ৬০ জন শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। খণ্ডকালীন মৌসুমি শ্রমিক কাজ করেন। আরও দক্ষ জনবল দরকার।’

ওলি উল্লাহ বলেন, ‘কম্বাইন হারভেস্টারকে বাংলাদেশে বেশি বেশি প্রচলন ঘটাতে চাই। আমদানির বিকল্প হিসেবে কীভাবে দেশে উৎপাদন করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করছি। কম্বাইন হারভেস্টার এবং ধানের চারা লাগানো মেশিন রাইস ট্রান্সপ্লান্টার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।’

ওলি উল্লাহর কারখানায় কাজ শিখে ও অনুপ্রেরণা পেয়ে চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, ঝিনাইদহসহ সারা দেশে অন্তত ৮৬ জন কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন। যাঁদের একেকজনের কাছে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করছেন। অর্থাৎ তাঁদের ওপর বর্তমানে এক হাজার পরিবার নির্ভরশীল।

ব্যাংকঋণ ৫ কোটি এবং কিছু মহাজন ঋণ আছে। সব মিলে একটা ভালো অ্যামাউন্ট রান করছে। ওলি উল্লাহর দুই ভাই এবং একমাত্র ছেলে ওমিদুল ইসলামও জনতার ব্যবসা সম্প্রসারণে কাজ করে চলেছেন।

কৃষকেরা আমদানি করা যন্ত্রপাতির ওপর গুরুত্ব বেশি দেয়। বাংলাদেশে তৈরি যন্ত্রপাতির ওপর আস্থা কম রাখে। আউটলুকিং, ফিনিশিং ও রঙের দিক দিয়ে দেশে তৈরি যন্ত্র কিছুটা দুর্বল। ওলি উল্লাহর ভাষ্যমতে, আমদানির বিকল্প হিসেবে উৎপাদন চলছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকেরই কর্মসংস্থান হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে আমদানির বিকল্প হিসেবে কৃষি কাজের সব ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করতে সক্ষম হবেন বলে তিনি মনে করেন।