একসময় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এয়ারকন্ডিশনার (এসি) ছিল শহুরে বিলাসী জীবনের অনুষঙ্গ। এরপর ধীরে ধীরে বিভাগীয় ও জেলাপর্যায়ে উচ্চবিত্তরাও এসি ব্যবহার শুরু করেন। আর সময়ের ব্যবধানে এখন মধ্যবিত্তের ঘরেও বৈদ্যুতিক পাখার পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে এসি। সময়ের ব্যবধানে বিলাসিতার বদলে যাপিত জীবনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে এসি।
এ কারণে এসির বাজার যেমন দ্রুত বাড়ছে, তেমনি তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। জেলা শহরের পাশাপাশি এখন অনেক উপজেলাতেও এসির বিকিকিনি জমজমাট, যা এ যন্ত্রের বাজার বড় করতে বড় ভূমিকা রাখছে। আর বাজার বাড়তে থাকায় এখন এসি দেশে উৎপাদন ও সংযোজন হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত এসি বিক্রি দিন দিন বাড়লেও এখনো এ যন্ত্রের চাহিদার বড় অংশই আমদানিনির্ভর।
দেশে এসি উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ওয়ালটন, ইলেকট্রোমার্ট, ট্রান্সকম, এসকোয়্যার ইলেকট্রনিকস, সিঙ্গার বাংলাদেশ, বাটারফ্লাই, র্যাংগ্স ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল, মিনিস্টার, প্রাণসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
রাজধানীর একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক রিয়াসাদ ইসলাম সম্প্রতি মিরপুর থেকে বিদেশি ব্র্যান্ডের একটি এসি কিনেছেন। এসির প্রয়োজনীয়তা ও খরচ নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যে গরম পড়ে, তাতে বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে সামাল দেওয়া কঠিন। এ জন্য বাধ্য হয়ে এসি কিনেছি। এতে খরচ কিছুটা বাড়লেও রাতের ঘুমটা আরামদায়ক হয়। তাতে দিনের কাজটা যথাযথ মনোযোগ দিয়ে করতে পারি।’
বড় হচ্ছে এসির বাজার
এসির উৎপাদক ও পরিবেশকেরা বলছেন, করোনার আগে ২০১৯ সালে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার এসি বিক্রি হয়। ২০২০ সালে করোনার কারণে যা কমে সাড়ে তিন লাখে নেমে আসে। তবে গত বছর বিক্রি বেড়ে প্রায় ৪ লাখে উঠেছে। চলতি বছর ৪ লাখ ৩০ হাজার এসি বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান এ খাতের উৎপাদক ও পরিবেশকেরা।
গ্রি এসির বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রোমার্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসি এখন অতিপ্রয়োজনীয় যন্ত্র হয়ে উঠেছে। তবে করোনায় বড় ধাক্কা এসেছিল। তাতে বিক্রি কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। এখন অবশ্য বিক্রি আবার বাড়ছে। সরকার এসি উৎপাদনে কর ছাড় দিয়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে দামও নাগালের মধ্যে থাকবে।’
কোম্পানিভেদে এসির দামে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আবার শোরুমে ও দোকানে একই এসির দামেও রয়েছে পার্থক্য। অহরহ নকল হচ্ছে এ পণ্য। এ জন্য প্রকৃত পণ্য কিনতে শোরুম থেকে এসি কেনার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশকেরা।
বাজারে ব্র্যান্ডভেদে এক টনের বিদেশি ইনভার্টার এসির দাম ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। আর নন–ইনভার্টারের দাম ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। দেড় টন ইনভার্টার এসির দাম ৭৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকা।
এসকোয়্যার ইলেকট্রনিকস বাজারজাত করে জেনারেল, শার্প ও মিতসুবিশি ব্র্যান্ডের বিদেশি এসি। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মঞ্জুরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে ভালো এসির মধ্যে জেনারেলের অবস্থান এখনো এক নম্বরে। অন্য এসির চেয়ে দাম বেশি হলেও গ্রাহক সন্তুষ্টির কারণে প্রতিবছরই জেনারেল এসির বিক্রি বাড়ছে।’
সংযোজনের পর এখন দেশেই উৎপাদন
একসময় দেশের এসির বাজারের পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। এ জন্য দামও ছিল বেশি। দেশে চাহিদা বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে কারখানাগুলো বিদেশ থেকে সরঞ্জাম এনে দেশে সংযোজন শুরু করে। আর এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে এসি।
দেশে এসি বিক্রিতে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। সাশ্রয়ী মূল্যে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম রেখে দেশে এসি তৈরি করছে কোম্পানিটি। এতে অল্প সময়ের ব্যবধানে ওয়ালটনের এসি পৌঁছে গেছে শহর ছেড়ে গ্রামে–গঞ্জের ঘরবাড়িতে। এখন আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ও সুবিধার এসিও তৈরি করছে ওয়ালটন।
বিক্রির দিক থেকে শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে চীনের তৈরি গ্রি এসি। এ দেশে যেটি বাজারজাত করছে ইলেকট্রোমার্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সাল থেকে দেশেই গ্রি এসি উৎপাদন করছে, তবে মূল কমপ্রেসরসহ কিছু যন্ত্রাংশ আসছে বিদেশ থেকে। এ কারণে দামও কিছুটা কমেছে।
ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস বাজারজাত করছে ট্রান্সটেক, স্যামসাং, ডাইকিন, মিডিয়া, প্যানাসনিক, ওয়ার্লপুলের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের এসি। এর মধ্যে ট্রান্সটেক তৈরি হচ্ছে দেশেই। এ ছাড়া প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ ভিশন এসি, সিঙ্গার বাংলাদেশ দেশেই তৈরি করছে সিঙ্গার এসি। পাশাপাশি এলিট কোম্পানি এলিট ও বেইল ইলেকট্রনিকস তৈরি করছে বেইল এসি।
প্রাণ–আরএফএল এসি ব্যবসা শুরু করে ২০১৬ সালে। নরসিংদীর ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে নিজস্ব কারখানায় ভিশন ব্র্যান্ডের এসি তৈরি করে কোম্পানিটি। কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৮০ হাজার ইউনিট।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, বর্তমানে ভিশনের পাঁচ ধরনের এসি বাজারে রয়েছে। ভিশন এসির দাম ৩৯ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে। দিনে দিনে ভিশন এসির বিক্রি বাড়ছে।
এ ছাড়া বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেড ইকো প্লাস, এলজি, হায়ার ও স্যামসাং ব্র্যান্ডের এসি বাজারজাত করছে। ইলেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল বাজারজাত করছে ইলেকট্রা এসি ও র্যাংগ্স বাজারজাত করছে র্যাংগ্স এসি।
বাটারফ্লাইয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক সানি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলজির ডুয়েল ইনভার্টারে আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। কারণ, এটা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় করে।’
রপ্তানির হাতছানি
একসময় এসি, ফ্রিজসহ নানা ইলেকট্রনিক যন্ত্র বলতেই ছিল আমদানিনির্ভরতা। এতে দেশের মানুষের টাকা ডলারে রূপান্তর করে চলে যেত বিদেশে। সেই প্রথা ভাঙতে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়ালটন। আর দেশেই শুরু করে ইলেকট্রনিক পণ্য সংযোজন। পরে উৎপাদনেও যায়। দেশে উৎপাদন করে এখন বিদেশেও এসি রপ্তানি করছে ওয়ালটন। যার মাধ্যমে অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য।
এখন ওয়ালটনের এসি ৪০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। আবার প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারেও যাচ্ছে ওয়ালটনের এসি। ফলে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে এ ইলেকট্রনিক পণ্যটি।
আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি
বাজারে এখন দুই ধরনের এসি পাওয়া যায়। ইনভার্টার ও নন–ইনভার্টার। এর মধ্যে ইনভার্টারের দাম কিছুটা বেশি। কারণ, এ ধরনের এসিতে বিদ্যুৎ খরচ কম। এটি ঘরের আরামদায়ক তাপমাত্রা ঠিক রেখে এসির শক্তি খরচ কমিয়ে নিয়ে আসে।
পাশাপাশি আরও নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত হচ্ছে এসিতে। সম্প্রতি ‘ইনভার্না’ সিরিজের এসি এনেছে ওয়ালটন, যা উপমহাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। ১ টনের এ এসি ব্যবহারে ঘণ্টায় বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে মাত্র ২ টাকা ১৯ পয়সা। পাশাপাশি কোম্পানিটি বাংলা ভয়েস কন্ট্রোল এসি এনেছে। এর ফলে এখন রিমোট ব্যবহার ছাড়া বাংলায় কথা বলে ওয়ালটন এসি চালু বা বন্ধ করা যাচ্ছে। এ ছাড়া আরও নানা সুবিধার এসি বাজারে ছেড়েছে কোম্পানিগুলো। বেশি সুবিধার এসি মানে দামেও বেশি।
এসির বিক্রি নিয়ে রাজধানীর মিরপুরের সততা ইলেকট্রনিকসের কর্ণধার মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাহকভেদে এসির চাহিদা নির্ভর করে। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা ভালো ব্র্যান্ডের বাইরে যেতে চায় না। অন্যদের পছন্দ একটু কম দামি এসি। আর এখন ছোট সেলুন থেকে শুরু করে পাড়ার দোকানেও এসি ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, এ জন্য বিক্রিও ভালো।’