২০২০ সালে মোটরসাইকেল বিক্রি কমে গিয়েছিল। গত বছর বিক্রি বৃদ্ধির পেছনে চারটি বড় কারণের কথা জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।
করোনার কারণে দেশের মোটরসাইকেল খাতে যে মন্দাভাব তৈরি হয়েছিল, খাতটি তা কাটিয়ে উঠছে। ২০২১ সালে মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ। এ খাতের কোম্পানিগুলো বলছে, করোনার কারণে মোটরসাইকেল ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। সরবরাহ ঠিক থাকলে বিক্রি বাড়ার হার আরও কিছুটা বেশি হতো।
দেশের মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর নিজস্ব হিসাবে, ২০২১ সালে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৯০ হাজার মোটরসাইকেল, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১ লাখ বেশি। ২০২০ সালে মোটরসাইকেল বিক্রি আগের বছরের চেয়ে ১১ শতাংশ কম হয়েছিল।
মোটরসাইকেল বিক্রির এই হিসাব সেই অর্থে বাজার জরিপ নয়। হিসাবটি কোম্পানিগুলো নিজেরা বাজারের প্রবণতা বোঝার জন্য তৈরি করে। বিক্রি বাড়ার হার জানতে চারটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনটি কোম্পানি জানিয়েছে, বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশ করে। একটি জানিয়েছে, ১৫ শতাংশের বেশি হবে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে কত মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে, তার একটি হিসাব পাওয়া যায়। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, বিক্রি হওয়া মোটরসাইকেলের একটি বড় অংশ অনিবন্ধিত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পরে নিবন্ধন নেন ক্রেতারা।
মোটরসাইকেল বিক্রি বৃদ্ধির পেছনে কোম্পানিগুলো চারটি বড় কারণের কথা বলছে। প্রথমত, ২০২০ সালে করোনার কারণে কিছুদিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও, গত বছর তা হয়নি। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি গতিশীল ছিল। কৃষি পণ্যের দাম ভালো পেয়েছেন কৃষকেরা। তৃতীয়ত, করোনাকালে গণপরিবহন এড়াতে মানুষ ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল বেছে নিয়েছে এবং চতুর্থত, করোনাকালে কাজ হারানো অথবা কাজ না পাওয়া তরুণেরা শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিং পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। কেউ কেউ পণ্য ও খাবার সরবরাহ পেশায় যোগ দিয়েছেন। তাঁরাও মোটরসাইকেল কিনেছেন।
টিভিএস অটো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিপ্লব কুমার রায় বলেন, মোটরসাইকেল খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এটা বলা যাবে না। বলা যেতে পারে, ঘুরে দাঁড়ানোর পথে রয়েছে। তিনি বলেন, ক্রেতারা মোটরসাইকেল কিনতে চান। তবে তাঁরা আর্থিক চাপেও আছেন।
বাজার বড় ভারতীয় ব্র্যান্ডের
ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, হিরো ও টিভিএস এবং জাপানের ব্র্যান্ড হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা এখন দেশেই তৈরি হয়। তৈরি হয় বলতে, কিছু কিছু মডেলের মোটরসাইকেলের একটি বড় অংশের মূল্য সংযোজন হয় এ দেশে। আর কিছু কিছু মডেলের মোটরসাইকেল সংযোজিত হয়। অন্যদিকে দেশীয় ব্র্যান্ড রানার অনেক আগে থেকেই দেশে মোটরসাইকেল তৈরি করছে।
মোটরসাইকেল বাজারের বড় অংশই ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ভারতের বাজাজ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। এটির বিপণনকারী উত্তরা মোটরস। এর পরে রয়েছে ভারতের টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল, বিপণনকারী টিভিএস অটো বাংলাদেশ। ভারতের হিরো ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিপণনকারী এইচএমসিএল নিলয় বাংলাদেশ লিমিটেড। এই তিন কোম্পানির হাতেই বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি হিস্যা। পাশাপাশি ২০২১ সালে এই তিন কোম্পানি ভালো করেছে। তাদের বিক্রি বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজাজ, টিভিএস ও হিরো বাংলাদেশের বাজারে অনেক আগে থেকে বিপণন শুরু করে। মানুষের কাছে ব্র্যান্ডগুলো সুপরিচিত ও জনপ্রিয়। এইচএমসিএল নিলয় বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) বিজয় কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ভারতীয় ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তার কারণ, এগুলোর দাম তুলনামূলক কম এবং মানসম্পন্ন। আবার যন্ত্রাংশের দাম ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কম।
জাপানি ব্র্যান্ডের বিক্রি দ্রুত বাড়ছে
বাজার হিস্যায় ভারতীয় তিনটি ব্র্যান্ডের পরে রয়েছে তিনটি জাপানি ব্র্যান্ড—হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা। জাপানি ব্র্যান্ডগুলোর বাজার এখনো ছোট হলেও, তাদের বিক্রি দ্রুত বাড়ছে। হোন্ডা ২০২১ সালে ৭০ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে। বিক্রি বাড়ার হার ৫০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেডের (বিএইচএল) অর্থায়ন ও বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান শাহ মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, জাপানি ব্র্যান্ডগুলোর মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়ার কারণ মানুষের আস্থা। পাশাপাশি জাপানি ব্র্যান্ডগুলো দাম কমিয়ে প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় আসতে পেরেছে।
বাংলাদেশে জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিপণনকারী এসিআই মোটরস এবং সুজুকি মোটরসাইকেলের বিপণনকারী র্যানকন মোটরবাইক। এসিআই দাবি করেছে, ২০২১ সালে তারা ৪৭ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি। পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে।
এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জাপানি মান সম্পর্কে জানে। এ কারণে পুরোনো জাপানি গাড়ি দেশে বেশি বিক্রি হয়। তিনি বলেন, জাপানি মোটরসাইকেলের রি-সেল ভ্যালুও (পুরোনো হলে বিক্রিতে দাম) ভালো।
দুশ্চিন্তা ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে
মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কারণ, বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জাহাজভাড়া ও ডলারের বিনিময়মূল্য। অমিক্রনের কারণেও উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে।
একটি কোম্পানির সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিক্রি বাড়লেও মুনাফার হার কমে যাচ্ছে। ফলে নতুন বছরে দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হতে পারে।