সাক্ষাৎকার : খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

মূল্য বিপর্যয় রোধে চামড়ার বাজার উন্মুক্ত করা দরকার

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)কয়েক বছর ধরেই কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমছে। এতে চামড়া খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই বাস্তবতায় চলতি বছর চামড়ার বাজার নিয়ে কথা বলেছেন একজন অর্থনীতিবিদ ও দুজন ব্যবসায়ী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রণব বল, শুভংকর কর্মকার আরিফুর রহমান

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বিপর্যয়ের জন্য কারা দায়ী?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: দেশে চামড়ার কী পরিমাণ চাহিদা ও মজুত রয়েছে এবং আগামী দিনে চাহিদা বৃদ্ধির কতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে কাঁচা চামড়ার কেনাকাটা হয়। কোরবানির আগে এসব বিষয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে পরিষ্কার ধারণা না দেওয়ার কারণেই বছর বছর কাঁচা চামড়ার দামে বিপর্যয় হচ্ছে। এ জন্য অবশ্যই চামড়ার মূল ব্যবহারকারী হিসেবে ট্যানারিমালিকদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবও দায়ী। এ জন্য ট্যানারিমালিকেরা দায় এড়াতে পারেন না। সেই দায়ভার আড়তদারদের ওপরও বর্তায়। কারণ, তাঁরাও সরবরাহব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঘাটতি কোথায় ছিল?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: সারা বছর দেশের কারখানাগুলোতে কত বর্গফুট চামড়া প্রয়োজন, তার মধ্যে কোরবানির সময় কতটুকু চামড়া মিলবে এবং কত চামড়া মজুত আছে, সেই পরিসংখ্যান জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেটি খুঁজে বের করছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঈদের আগে চামড়ার মূল্য নির্ধারণে একধরনের উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। চলতি বছর তিনটি কমিটিও করেছে তারা। মূলত কোরবানির চামড়া যাতে কেউ ফেলে না দেয়, সে জন্য বেশি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে শুধু নজরদারি করে যে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়, সেটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

এদিকে চামড়ার মূল্য নির্ধারণেও একধরনের অস্বচ্ছতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে লবণযুক্ত চামড়ার পাশাপাশি লবণ ছাড়া চামড়ার দামও নির্ধারণ করা, যাতে করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদেরও বাজার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকে। চামড়ার বর্গফুটের হিসাবেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা একটা হিসাব করে নিয়ে আসেন, সেটিকে আবার আড়তদারেরা স্বীকার করতে চান না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মূল্য বিপর্যয় হয়। এ ক্ষেত্রেও একটি পরিষ্কার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন।

কাঁচা চামড়ার লেনদেন প্রচুর বাকিতে হয়। এতে করে বিস্তর সমস্যাও হচ্ছে। গতবার ট্যানারিমালিকদের বিরুদ্ধে আড়তদারেরা অভিযোগ করেন, তাঁরা আগের টাকা দেননি। অন্যদিকে ট্যানারিমালিকেরা বলেন, ব্যাংক তাঁদের ঋণ দিচ্ছে না। তাই এ পর্যায়ের ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা আনা দরকার। আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসায় যেভাবে প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেন হয়, এখানে সেটি নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিতে পারে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: চামড়ার মূল্য বিপর্যয় রোধে আর কী করা প্রয়োজন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে দেশীয় ক্রেতার সংখ্যা বেশি এবং সীমিতসংখ্যক বিদেশি ক্রেতার কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো নিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে কোনো চাপ আসে না। কাঁচা চামড়ার বাজারটি পুরোপুরি দেশীয়। অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশীয় শিল্পের কাঁচামালের থেকেও নিম্ন পর্যায়ের একটি ব্যবস্থা এখানে গড়ে উঠেছে। এটিকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।

আমাদের চামড়ার প্রক্রিয়াকরণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী না হওয়ার পাশাপাশি সীমিতসংখ্যক ট্যানারি ও পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি ক্রেতার কারণে বাজারের আকার খুবই ছোট। আবার পাচারের অভিযোগ এনে পার্শ্ববর্তী দেশে রপ্তানি বন্ধ করে পুরো বাজারটিকে অভ্যন্তরীণমুখী করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে আড়তদার, ট্যানারিমালিক, জুতা ও চামড়া পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে এ সুবিধার অপব্যবহার করে চলেছেন। ফলে চামড়ার বাজার উন্মুক্ত করা দরকার।

চলতি বছর ওয়েট ব্লু রপ্তানির জন্য পাঁচটি কোম্পানিকে অনুমতি দিয়েছে সরকার। তারা এক কোটি বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করতে পারবে। এ উদ্যোগ ইতিবাচক। এ জন্য কাঁচা চামড়ার দামে কিছুটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেহেতু দেশের ভেতরে চাহিদা খুব বেশি সৃষ্টি হচ্ছে না, তাই আগামী বছরগুলোতে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি অব্যাহত রাখা দরকার।