মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র

ভ্যাট অব্যাহতি নিয়ে টানাপোড়েন

এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভ্যাট বা মূসক অব্যাহতি চেয়ে আবারও জাপানের চিঠি। কিন্তু বাংলাদেশ এ সুবিধা দিতে রাজি নয়।

  • আরও দুটি প্রকল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও তা চাওয়া হয়েছে।

  • এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভ্যাট অব্যাহতি দিলে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল প্রকল্পেও একই দাবি ওঠার আশঙ্কা সরকারের।

মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র

মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট বা মূসক) অব্যাহতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাপানের টানাপোড়েন চলছে। দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় দুই বছর ধরে চলা এই জটিলতার সুরাহা হচ্ছে না। জাপান বলছে, সমজাতীয় কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়াকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরে রামনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সে জন্য জাপানও প্রশ্ন তুলেছে, একই সুবিধা অন্যদের দেওয়া হলে তাদের কেন দেওয়া হবে না? অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ঢালাও সুবিধা দেওয়ার বিপক্ষে। এই নিয়ে উভয় পক্ষ চিঠি চালাচালির মধ্যে আছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০টি প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি। ৩৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে ২৯ হাজার কোটি টাকাই ঋণ দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৭ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে।

১ হাজার ৬০০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই প্রকল্পের আওতায় শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়, গভীর সমুদ্রবন্দর এবং খাল খননের কাজও রয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য লাইন ও উপকেন্দ্র তৈরি এবং সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের কথা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে জাপানের সুমিতিমো করপোরেশন, তোশিবা এনার্জি সিস্টেম ও আইএইচটি কো-অপারেশন।

বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে মূসক বা ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি গত ২৫ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি বলেন, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করতে ঠিকাদারদের দুবার ভ্যাট দিতে হচ্ছে। দ্বৈত ভ্যাট আরোপের কারণে ঠিকাদারদের অতিরিক্ত ১৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে, যা খুবই উদ্বেগজনক। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অর্থমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে ইতো নাওকি আরও বলেন, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পটুয়াখালীর পায়রাতে রামনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দুটি প্রকল্প। সরকার এই দুটি প্রকল্পে এরই মধ্যে ভ্যাট মওকুফ করে দিয়ে এসআরও জারি করেছে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০টি প্রকল্পের একটি। সে জন্য এই প্রকল্পেও একইভাবে এসআরও জারি করে ভ্যাট মওকুফের প্রস্তাব দেন ইতো নাওকি।

জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) মাসুদ সাদিক বলেন, ‘জাপানের রাষ্ট্রদূত যে চিঠি দিয়েছেন, সেটি আমরা পেয়েছি। তবে সেখানে দ্বৈত ভ্যাটের বিষয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। একই অর্থনৈতিক কার্যক্রমে দুবার ভ্যাট নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে নতুন নতুন অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু হলে সেখানে তো দুবার ভ্যাট দিতেই হবে।’ মাসুদ সাদিক প্রশ্ন করেন, সব প্রকল্পে যদি এভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়, তাহলে সরকার টাকা পাবে কোত্থেকে? দেশ চলবে কীভাবে? এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভ্যাট অব্যাহতি দিলে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল প্রকল্পেও ভ্যাট ছাড়ের দাবি উঠতে পারে। এভাবে ছাড় দিতে থাকলে স্বচ্ছতা থাকবে না।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিকাদারকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে গত দুই বছরে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে এই প্রকল্পে ভ্যাট অব্যাহতি না দেওয়ার মত এসেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি পুরোপুরি ব্যতিক্রমী প্রকল্প। তাই বিশেষ বিবেচনায় ওই প্রকল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। রামনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পায়রা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেডকেও (পিডিসিএল) বিশেষ বিবেচনায় সমান সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন যদি জাপানকে একই সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে ভারতও তাদের অর্থায়নে চলমান প্রকল্পে তা চাইবে। পাশাপাশি চীন চাইবে, সিঙ্গাপুরও চাইবে। এতে একটি খারাপ ধারা চালু হবে।

জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যকার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ করে বিষয়টির সুন্দর সুরাহা চেয়েছেন রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। চিঠিতে তিনি আশা করেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর আগের দুটি উদাহরণ বিচার–বিশ্লেষণ করে মাতারবাড়ী প্রকল্পেও সমান সুবিধার ব্যবস্থা করবে। এর আগেও কয়েকবার চিঠি দিলেও বিষয়টি সুরাহা হয়নি বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ভ্যাট বা মূসক অব্যাহতি দিতে আগ্রহী নয় এনবিআর।