পাঁচ বছর আগে ২০১৫–১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
গত মৌসুমে বিশ্বে হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। দেশটিতে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ফলন হয়েছে। আর গত বছর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে পৌনে ১০ টন।
ভুট্টা চাষে কম সময়েই সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যান্য খাদ্যশস্যের চেয়ে কম পরিচর্যা ও কম সেচ খরচে ভালো ফলন হয় এবং দামও ভালো পাওয়া যায় বলে ভুট্টা চাষে কৃষকেরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ফলে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়ছে। মাত্র পাঁচ বছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
মার্কিন কৃষি বিভাগের গত আগস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মৌসুমে বিশ্বে হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। দেশটিতে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ফলন হয়েছে। এক বছর আগে তালিকার শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবার হেক্টরপ্রতি সাড়ে ১০ টন ফলন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে পৌনে ১০ টন। আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০১৮–১৯ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ৮ টনের কিছু বেশি। সরকারি দুই সংস্থার হিসাবে কিছুটা হেরফের থাকলেও ভুট্টার উৎপাদন যে বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রতিবছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে ভুট্টার একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। চাহিদা থাকায় চাষ বাড়ছে। ফলনেও সাফল্য এসেছে।আব্দুর রাজ্জাক, কৃষিমন্ত্রী
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে প্রতিবছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে ভুট্টার একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। চাহিদা থাকায় চাষ বাড়ছে। ফলনেও সাফল্য এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারের ফলে এ অঞ্চলে ভুট্টার সর্বোচ্চ ফলন হয় বাংলাদেশে।
ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে উৎপাদন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, পাঁচ বছর আগে ২০১৫–১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। আগাম বন্যার কারণে এবার অনেক জায়গায় ভুট্টার আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপরও উৎপাদন অর্ধকোটি টনের কাছাকাছি থাকবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা মনে করেন।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছিল।
দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। তবে ভুট্টা উৎপাদনের অর্ধেকই হয় রংপুর বিভাগে। উৎপাদনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ। জেলা হিসেবে দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভুট্টার উৎপাদন বেশি।
মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশই হয় শীত মৌসুমে। এলাকাভেদে ফলন ওঠে মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত। দেশীয় ফলনের সময় আমদানির দরকার হয় না। এ কারণে দেশে ভুট্টার আমদানি দিন দিন কমছে।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার গোয়ালদিহি ইউনিয়নে এবার ২৪ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছেন আতাউর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে ভুট্টায় বিঘাপ্রতি খরচের সমান মুনাফা হয়েছে। এ কারণে ভুট্টার আবাদে ঝুঁকছেন তিনি। তবে এবার করোনার কারণে তাঁরা শুধু খরচের টাকা তুলতে বা কম মুনাফা করতে পেরেছেন।
দেশে গ্রীষ্ম ও শীত—এ দুই মৌসুমে ভুট্টা চাষ হয়। তবে মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশই হয় শীত মৌসুমে। এলাকাভেদে ফলন ওঠে মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত। দেশীয় ফলনের সময় আমদানির দরকার হয় না। এ কারণে দেশে ভুট্টার আমদানি দিন দিন কমছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৭–১৮ অর্থবছরে ১৫ লাখ টন ভুট্টা আমদানি হয়েছিল। গত অর্থবছরে তা কমে ১৪ লাখ টনে নেমেছে।
বাজার বড় হচ্ছে
প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, দেশে প্রাণিখাদ্যের বাজার বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস–মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই ভুট্টা থেকে আসে। এর মধ্যে মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ১২–১৫ শতাংশ। এ তিন খাতে বছরে ৪৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে। এদিকে মানুষের খাওয়ার উপযোগী মিষ্টি ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে।
ভুট্টা রপ্তানির জন্য আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেজিং কৌশলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। এগুলো করা হলে বৈশ্বিক বাজারে ভুট্টা রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়বে।শাকিল আহমেদ, ভুট্টা রপ্তানিকারক
প্রাণিখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নাহার অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দেশে ভুট্টার বাজারের আকার প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশে ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার। আর আমদানি হয় (গত অর্থবছর) আড়াই হাজার কোটি টাকার ভুট্টা।
রপ্তানির সম্ভাবনা
চট্টগ্রামের গ্রিনগ্রেইন গ্রুপের কর্ণধার শাকিল আহমেদ প্রায় এক যুগ আগে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ইয়েমেনে ভুট্টার তিনটি চালান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরোধিতায় রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় তিনি আর ভুট্টা রপ্তানি করতে পারেননি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে নেপালে ১ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১৪৬ কোটি টাকার ভুট্টা রপ্তানি হয়েছে। এ সম্পর্কে রপ্তানিকারক শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, ভুট্টা রপ্তানির জন্য আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেজিং কৌশলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। এগুলো করা হলে বৈশ্বিক বাজারে ভুট্টা রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়বে।