চামড়াশিল্প নগর

‘ব্যর্থতার দায় সব পক্ষের’

চামড়াশিল্প নগর পুরোপুরি প্রস্তুত না করে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করায় হেমায়েতপুরে পরিবেশদূষণ হচ্ছে। আট বছরেও হয়নি সিইটিপি।

সাভারের হেমায়েতপুরে দুই শ একর জমির ওপর একটি পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগর করতে ১৭ বছর পার করেছে সরকার। এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জন্য নির্ধারিত জায়গায় ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজও শুরু হয়নি।

চামড়াশিল্প নগর পুরোপুরি প্রস্তুত না করে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করায় হেমায়েতপুরে এখন পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের চামড়া কিনছে না। সে কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে চামড়া ও চামড়াপণ্যের রপ্তানি কমছে। অন্যদিকে চার বছর ধরে কোরবানির চামড়ার দামও কম। গত বছর তা তলানিতে ঠেকে। কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে চামড়া পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটে। এ বছরও কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হয়েছে পানির দরে।

২০০৩ সালে নেওয়া চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের কাজ পরিকল্পিতভাবে শেষ করতে না পারার যে ব্যর্থতা, সেই দায়ভার কাউকে না কাউকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালের পর আমরা চলমান ব্যবসা হারিয়ে ফেললাম। তার দায় তো কাউকে নিতে হবে।’

এই ব্যবসায়ীর কথার সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগর আমাদের জন্য একটি লেসন (শিক্ষা)। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। ব্যর্থতার পেছনে সব পক্ষের দায় আছে। হাজারীবাগের মতো সাভারেও পরিবেশ দূষণ হওয়াটা দুঃখজনক। আসলে চীনারা ঠিকভাবে কাজ করেনি।’

চামড়া খাত নিয়ে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় গতকাল মঙ্গলবার এসব কথা বলেন সালমান এফ রহমান। দি এশিয়া ফাউন্ডেশন ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (আরএপিআইডি) সহযোগিতায় আয়োজিত এই আলোচনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরএপিআইডির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষক আবু ইউসুফ। সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল ইসলাম।

সাভারের চামড়াশিল্প নগরের ১৫৫টি ট্যানারির জন্য সিইটিপি নির্মাণের জন্য চীনা প্রতিষ্ঠান জেএলইপিসিএ-ডিসিএল জেভিকে ২০১২ সালের ১১ মার্চ কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কথা ছিল দেড় বছরের মধ্যে সিইটিপি নির্মাণ শেষ হবে। তবে তা আট বছরেও হয়নি। এই সিইটিপি যে খুব সহজে এলডব্লিউজি সনদ পাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে রপ্তানিমুখী ট্যানারির মালিকদের। এ কারণে গত জুলাইয়ে অ্যাপেক্স ও বে নিজস্ব ইটিপি স্থাপনের অনুমোদন নেয়।

অবশ্য বর্তমান সিইটিপিতে যেসব যন্ত্রাংশ লাগানো হয়েছে, সেগুলো পরিবর্তন করা হলেই দেশি-বিদেশি মানে পৌঁছানো যাবে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি আরও বলেন, ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা না গেলে আমাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।’

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘সিইটিপিতে গত মে, জুন ও জুলাই মাসে পরিশোধনের পর পানির যে মান হয়েছে, তা পরিবেশ অধিদপ্তরের মানদণ্ড পূরণ করে। তবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরিশোধিত পানির মান আবার খারাপ হয়েছে।’ এর জন্য ট্যানারির মালিকদের দায়ী করে তিনি বলেন, ‘চামড়া প্রক্রিয়াকরণে আপনারা বেশি পানি ব্যবহার করছেন। এটি নিয়ন্ত্রণ না করলে আমরা পানির ওপর কর বসাব।’

সাভারের চামড়াশিল্প নগর কবে পুরোপুরি প্রস্তুত হবে, সেই দিনক্ষণ বেঁধে বলতে পারছে না সরকার। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে নতুন সংকটে পড়েছে চামড়া খাত। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চামড়া ও চামড়াপণ্যের রপ্তানি কমেছে সাড়ে ১৬ শতাংশ।

করোনার কারণে বৈশ্বিক পর্যটন ৫৮ থেকে ৭৮ শতাংশ কমে যাচ্ছে, যা সরাসরি চামড়াপণ্যের বিক্রির নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সারা বিশ্বে চলতি বছর জুতা ক্রয় কমবে সাড়ে ২২ শতাংশ—এমন তথ্য দিয়ে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘মানুষ টাকা বাঁচিয়ে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য। ফলে রপ্তানি বেশ কমেছে। আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।’

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, নানা কারণে চামড়াপণ্যের চাহিদা কমবে। রপ্তানির পরিমাণ কমবে। তবে আয় বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য পুরো চামড়া খাত দেখভাল করার জন্য একটি আলাদা সংস্থার প্রয়োজন। তা ছাড়া প্রতিটি রপ্তানি খাতের জন্য সমান সুযোগ প্রত্যাশা করেন তিনি।

২০১৭ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে বর্ষসেরা পণ্য ঘোষণা করেছিল সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য ৫০০ কোটি ডলার নির্ধারণ করা হয়। তবে গত চার বছরে সেই লক্ষ্যের চেয়ে কেবলই পিছিয়েছে খাতটি। খাতটির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ৫ বছর মেয়াদি একটি কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু ইউসুফ।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের চামড়া এবং চামড়াপণ্যের রপ্তানি ছিল ১৫ কোটি ডলার। বর্তমানে ভিয়েতনামের রপ্তানি ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি। বাংলাদেশের মতো কাঁচা চামড়ার উৎস না থাকার পরও ভিয়েতনামে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া ১৪টি ট্যানারি আছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না!