বিশ্বের শীর্ষ ১০০ কনটেইনার জাহাজ কোম্পানির মর্যাদাপূর্ণ তালিকায় প্রথমবারের মতো ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের এইচআর লাইনস। শিপিংবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান আলফা লাইনারের হালনাগাদ তালিকায় ৭১ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানটির নাম।
তালিকায় বাংলাদেশের এইচআর লাইনসের দুই ধাপ ওপরে আছে প্রতিবেশী ভারতের সরকারি শিপিং করপোরেশন। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশের কোনো শিপিং কোম্পানির নাম নেই এ তালিকায়। আবার বেসরকারি খাত বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ায় এখন এইচআর লাইনসই শীর্ষে। বিশ্বের কনটেইনার শিপিং কোম্পানিগুলোর বহরে থাকা জাহাজের কনটেইনার পরিবহনক্ষমতা মূল্যায়নের ভিত্তিতে তালিকাটি তৈরি করেছে আলফা লাইনার।
এইচআর লাইনস কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ পরিচালনায় এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৯ হাজার একক কনটেইনার পরিবহনের ক্ষমতা রাখে। লাল-সবুজ পতাকাবাহী ছয়টি জাহাজ পরিচালনা করছে তারা। সব জাহাজই তাদের মূল প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী লিমিটেডের। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর দুই সন্তান এইচআর লাইনসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে এইচআর লাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কর্ণফুলী লিমিটেডের পরিচালক রাইমা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক তালিকায় ঠাঁই পাওয়া শুধু এইচআর লাইনসের জন্য নয়, দেশের জন্যও গৌরবের। গ্রাহকদের উন্নত মানের সেবা প্রদানের মাধ্যমে এইচআর লাইনস আরও এগিয়ে যেতে চায়।
জানা গেছে, কনটেইনার জাহাজ কোম্পানির এই তালিকায় দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষে ছিল ডেনমার্কভিত্তিক মার্সক। সেটিকে পেছনে ফেলে এবার এক নম্বরে উঠে এসেছে সুইজারল্যান্ডের মেডিটারিয়েন শিপিং কোম্পানি। প্রথমবারের মতো এ তালিকায় স্থান পেয়ে এইচআর লাইনস বিশ্বে কনটেইনার জাহাজ পরিবহনের জগতে বাংলাদেশের উপস্থিতির জানান দিল।
বৈশ্বিক তালিকায় জায়গা করে নেওয়া এইচআর লাইনসের যাত্রা শুরু হয় মাত্র বছর দেড়েক আগে, করোনা মহামারির মধ্যে। ২০২০ সালের জুনে ‘এমভি সারেরা’ ও ‘এমভি সাহারে’ নামের দুটি জাহাজ দিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর গত বছর প্রতিষ্ঠানটির বহরে যোগ হয় আরও চারটি জাহাজ। চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং এবং চট্টগ্রাম থেকে শ্রীলঙ্কার কলম্বো রুটে চলছে ছয়টি জাহাজ। বাংলাদেশের সিংহভাগ আমদানি পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দুটি সমুদ্রপথ ধরেই আসছে। আবার দুই পথ ধরেই রপ্তানি পণ্য যাচ্ছে বিদেশের বিভিন্ন বন্দরে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চীন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও ইতালিতে কনটেইনার জাহাজের চলাচল রয়েছে। বর্তমানে এসব রুটে বিভিন্ন দেশের ২৫টি জাহাজ কোম্পানির দেড় লাখ একক কনটেইনার পরিবহনক্ষমতার ৮৫টির মতো জাহাজ চলাচল করছে। এমএসসি, মার্সক, সিএমএসিজিএমসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো চট্টগ্রাম রুটে জাহাজ পরিচালনা করলেও এইচআর লাইনসই একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান।
এখন দেশের একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এই খাতে আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ জন্য সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পের জন্য সরকারি নীতিসহায়তা বাড়ানো দরকার।আজম জে চৌধুরী, সভাপতি, সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতি
বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ সংরক্ষণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী, দেশীয় জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সুবিধা না পেলেও গ্রাহক সেবার মান বাড়িয়ে ব্যবসা করে আসছে এইচআর লাইনস। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে কনটেইনার পরিবহনের ২৫ শতাংশ হিস্যা এখন দেশীয় প্রতিষ্ঠানটির হাতে। আর সার্বিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট কনটেইনার পরিবহনের ৮ শতাংশ এ প্রতিষ্ঠানের জাহাজে পরিবহন হচ্ছে।
এইচআর লাইনসের মূল প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী লিমিটেড শিপিং ব্যবসায় দেশের প্রথম প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের হেদায়েত হোসেন চৌধুরীর হাত ধরে গ্রুপটির যাত্রা শুরু হয়। হেদায়েত হোসেন চৌধুরীর ছেলে সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর পর এখন প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিচ্ছে তৃতীয় প্রজন্ম। কনটেইনার শিপিং কোম্পানির এজেন্সি হিসেবে এটি যুক্ত হয় ৩৪ বছর আগে। গ্রুপটি চারটি ফিডার অপারেটর কোম্পানি ও পাঁচটি মেইন লাইন অপারেটর এজেন্সি পরিচালনার ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে। শিপিং ছাড়াও বেসরকারি কনটেইনার ডিপোসহ লজিস্টিকস কোম্পানিতেও বিনিয়োগ রয়েছে গ্রুপটির।
এইচআর লাইনসের ৬টি জাহাজ এখন প্রতি মাসে ১৭ হাজার কনটেইনার পরিবহন করছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটি মাসে ৩৫-৩৬ লাখ ডলার বা ৩০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। দেশীয় কনটেইনারবাহী পণ্য আমদানি করে পরোক্ষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে প্রতিষ্ঠানটি।
আলফা লাইনারের তথ্য অনুযায়ী এইচআর লাইনসের বহরে ১৭ হাজার ৪০০ কনটেইনার পরিবহনক্ষমতার আরও ৬টি জাহাজ যুক্ত হবে। কোম্পানিটির বিদ্যমান বহরে পণ্য পরিবহনের যে জাহাজ রয়েছে, তার তুলনায় সামনে যুক্ত হওয়া জাহাজগুলোর মাধ্যমে কনটেইনার পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা ১৮৮ শতাংশ বেশি হবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কর্ণফুলী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এইচআর লাইনসের পরিচালক হামদান হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে এইচআর লাইনসের বহর বাড়ানোর বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি।’
বাংলাদেশ কনটেইনার জাহাজ কোম্পানির ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৯৯৭ সালে এইচআরসি শিপিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ হোসেন চৌধুরীর হাত ধরে। প্রায় একই সময়ে যুক্ত হয়েছিল কিউসি কনটেইনার লাইন। দুটো প্রতিষ্ঠানই এক দশকের মধ্যে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। এক দশক পর সাঈদ হোসেন চৌধুরীর ছোট ভাই সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর হাত ধরে আবারও তা শুরু হয়। এবারে সাবের চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান তো বৈশ্বিক তালিকায় শীর্ষ ১০০ কোম্পানির মধ্যে স্থান পেয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ৮০টি সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে কনটেইনার জাহাজ মাত্র ছয়টি। এ ছয়টি জাহাজই এইচআর লাইনসের। এদিকে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজের মতো কনটেইনার জাহাজশিল্পে বিনিয়োগের বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সভাপতি ও ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে কনটেইনার জাহাজে পণ্য পরিবহন বাড়ছে। এতে সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজে বিনিয়োগের বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন দেশের একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এই খাতে আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ জন্য সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পের জন্য সরকারি নীতিসহায়তা বাড়ানো দরকার।