করপোরেশনের সিদ্ধান্ত

বন্ধ হচ্ছে সরকারি ছয় চিনিকল

বন্ধ হলেও কোনো কর্মী বাদ যাবেন না। এসব চিনিকলের অধীনে থাকা চাষিদের কাছ থেকেও আখ কিনবে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন।

পঞ্চগড় চিনিকল ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ লোকসানের কারণে চিনিকলটি বন্ধের আশঙ্কা করছেন আখচাষি, শ্রমিক ও কর্মচারীরা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

লোকসানের বোঝা কমাতে সরকারি ছয় চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। আপাতত এসব চিনিকলে চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের আখমাড়াই বন্ধ করা হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগে জরাজীর্ণ কারখানাগুলো আধুনিকায়ন করে চিনির পাশাপাশি স্পিরিট, অ্যালকোহলসহ অন্যান্য উপজাত পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সংস্থাটি।

উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া চিনিকলগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল। সব মিলিয়ে করপোরেশনের অধীনে রয়েছে ১৫টি চিনিকল। ছয়টি চিনিকল বন্ধ হলেও বাকি নয়টিতে আখমাড়াই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এমনকি ছয় চিনিকলের অধীনে থাকা চাষিদের আখ কিনবে করপোরেশন। সেই আখ চালু থাকা চিনিকলে মাড়াই হবে। বন্ধ হওয়া ছয় চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক কর্মচারী কর্মরত।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারের সব কটি চিনিকলেই বর্তমান বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে উৎপাদিত হচ্ছে চিনি। তাতে গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে করপোরেশন। তার মধ্যে বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। তা ছাড়া ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের দায় রয়েছে করপোরেশনের ঘাড়ে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্য তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

উৎপাদন বন্ধ থাকা কারখানার শ্রমিকদের পার্শ্ববর্তী চিনিকলে বদলি করা হবে। ফলে চিনিকল বন্ধ হলেও আখচাষি ও কারখানার কর্মীদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
সনৎ কুমার সাহা, চেয়ারম্যান, বিএসএফআইসি

চিনিকল বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি চিনিকলে চলতি অর্থবছর আখমাড়াই স্থগিত থাকবে। তবে চাষিদের সব আখ কিনে নেবে সরকার। সেগুলো চালু থাকা চিনিকলে পাঠানো হবে। চিনিকলের কোনো শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হবে না। উৎপাদন বন্ধ থাকা কারখানার শ্রমিকদের পার্শ্ববর্তী চিনিকলে বদলি করা হবে। ফলে চিনিকল বন্ধ হলেও আখচাষি ও কারখানার কর্মীদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।

সনৎ কুমার সাহা বলেন, ‘লোকসান কমানোর প্রথম ধাপ হিসেবে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করা হয়েছে। জাপান ও থাইল্যান্ড আমাদের চিনিকলে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায়। করোনার কারণে পুরো বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে।’

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। পরে সুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন দুটি একীভূত করে বিএসএফআইসি গঠিত হয়েছে। তখন সংস্থাটির অধীনে ছিল ৭২টি প্রতিষ্ঠান। পরে আরও চারটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন সময় ৫৯টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে করপোরেশনের অধীনে ১৫টি চিনিকল, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা ও তিনটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

লোকসান কতটুকু কমবে?

কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর, রংপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৩৮০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। তার মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকল ৬১ কোটি, পাবনা ৭৪, পঞ্চগড় ৪৭, শ্যামপুর ৫৯, রংপুর ৫৩ এবং সেতাবগঞ্জ ৮৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।

রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গত মৌসুমে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। এই চিনিকলের ১৫৮ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ আছে। এর সুদ হিসাব করলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। সেই চিনি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা কেজি দরে। পঞ্চগড় চিনিকলে গত মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ছিল ৩০২ টাকা (সুদসহ)। একইভাবে প্রতি কেজি উৎপাদনে কুষ্টিয়ায় ২৭৩, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯ এবং পাবনায় ১৭৮ টাকা ব্যয় হয়েছে। আর বিক্রি হয়েছে ৫৩ থেকে ৫৭ টাকা কেজি দরে।

শেয়ারের দরপতন

বিএসএফআইসির তিনটি প্রতিষ্ঠান—শ্যামপুর সুগার মিল, জিলবাংলা সুগার মিল ও রেনউইক যজ্ঞেশ্বর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। গতকাল শ্যামপুর সুগার মিল বিনিয়োগকারীদের জানায়, চলতি অর্থবছর তারা চিনি উৎপাদন করবে না। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

উৎপাদন বন্ধের ঘোষণায় গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রায় ৫ শতাংশ বা ৩ টাকা কমে যায়। দাম নেমে আসে প্রায় ৫৯ টাকায়। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশও দিতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে এটি নিম্নমানের কোম্পানি হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত রয়েছে।

বরাদ্দ ৪০৭ কোটি টাকা

অর্থসংকটের কারণে বিভিন্ন চিনিকলে তিন থেকে চার মাসের মজুরি ও বেতন বকেয়া পড়েছে। পাওনার দাবিতে প্রায়ই শ্রমিকেরা রাস্তায় নামছেন। আন্দোলন করছেন। এমনকি টাকার অভাবে চলতি মৌসুমে নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি ৪০৭ টাকা অর্থসহায়তা পেয়েছে করপোরেশন।

এ বিষয়ে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা বলেন, চলতি মৌসুমের আখমাড়াইয়ের জন্য ২৮৪ কোটি ও কৃষকদের ভর্তুকি বাবদ ১২৩ কোটি টাকা ছাড় করেছে সরকার। এই টাকা দিয়ে বকেয়া বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হবে।