প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিতে আবাদ

গ্রামের মানুষকে আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করতে ৪৭০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে কাজ হারিয়ে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। একই কারণে বিদেশ থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিরাও এখন গ্রামে। করোনাকালে দেড় কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক মহামারির বিরূপ প্রভাবে গত এক বছরে গ্রামীণ অর্থনীতি চাপে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় গ্রামের মানুষকে আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করতে সরকার একটি কৃষিভিত্তিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

জানা গেছে, ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ শীর্ষক এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ৪৭০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই দেবে সরকার। দেশের সব উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। এর আওতায় মোট ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯০৬টি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইতিমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রকল্প শেষ হবে ২০২৩ সালে। এতে সফলতা পাওয়া গেলে পরে আবারও তা নেওয়া হতে পারে।

প্রকল্পটির আওতায় গ্রামের মানুষ বসতবাড়ির আঙিনা, পুকুর ও খালের পাড়, বাড়ির আশপাশ, স্যাঁতসেঁতে ছায়াযুক্ত প্রতি ইঞ্চি অব্যবহৃত ও অনাবাদি জমিতে শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করবেন। এতে মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে বলে মনে করে কৃষি মন্ত্রণালয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে বর্তমানে পতিত ও অনাবাদি কিন্তু আবাদ হতে পারে এমন জমির পরিমাণ ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৬৮ হেক্টর। এই হিসাবে অবশ্য হাওর ও পাহাড়ের কিছু অংশ নেই। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে গত বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সেই নির্দেশনা দেন। এরপর পতিত জমিতে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শাকসবজি ও ফলমূল চাষাবাদের প্রকল্পটি হাতে নেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এর মাধ্যমে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন শাখার পরিচালক এ কে এম মনিরুল আলম বলেন, ‘দেশে অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার আছে, যারা এখনো শাকসবজি ও ফলমূল কিনে খায়। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে আমরা প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদের আওতায় নেওয়ার এই প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এর আওতায় জমিতে সারা বছরই যাতে সবজি ও ফল থাকে, সেই ব্যবস্থা করা হবে।

প্রকল্পে যা থাকছে

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এই প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে নেওয়া ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯০৬টি প্রদর্শনী খামারে ১২ ধরনের শাকসবজি উৎপাদন করা যাবে। একই সঙ্গে ফলের চাষও করা যাবে। শাকসবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ফুলকপি, মুলা, বেগুন, বাঁধাকপি, মরিচ, লাউ, কুমড়া; আর ফলের মধ্যে থাকবে মাল্টা, পেঁপে, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত খামারের মডেল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে একজন কৃষক সারা বছরই খামার থেকে কিছু না কিছু পাবেনই। কখনো সবজি থাকবে, আবার কখনো থাকবে ফল। এ জন্য প্রায় আড়াই লাখ কৃষক এবং ১০ হাজার কৃষি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

কারা পাবেন এই সুবিধা

কোন কোন পরিবার সরকারের এই সুবিধা পাবে, তার একটা মানদণ্ড ঠিক করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাতে বলা হয়েছে, যেসব পরিবারের এক থেকে দেড় শতাংশ পরিমাণ পতিত জমি আছে, তারা এই সুবিধা পাবে। প্রতি ইউনিয়নে ৩২টি প্রদর্শনী খামার হবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে ১ হাজার ৯৩৫ টাকা দেওয়া হবে। এর বাইরে বীজ ও সারের ব্যবস্থাসহ সাইনবোর্ড টাঙানোর কাজ করে দেবে সরকার।

এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘করোনার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ পড়েছে। এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি পড়ে থাকুক, সেটি আমরা চাই না। তাই এমন ব্যবস্থা করা হচ্ছে যে বাড়ির চারপাশে নানা ধরনের সবজি ও ফলমূল উৎপাদন করতে পারবেন কৃষক। প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে।’

অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে দেশে মানুষের খাদ্যের ৭০ শতাংশ ক্যালরি আসে ধান বা চাল থেকে। ধানের বাইরে বসতবাড়ির আশপাশে অনাবাদি জমিতে যদি কৃষক শাকসবজি ও ফলের চাষাবাদ শুরু করে, তখন খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসবে। কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরেই মানুষের বাড়ির আশপাশে জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে, যেখানে কখনো কিছু চাষ হয়নি এবং প্রযুক্তির ব্যবহারও হয়নি। এসব পতিত জমিকে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলনের উপযোগী করে তোলা হবে।