তৈরি পোশাক খাতে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। করোনাকালে সেই শ্রমিকেরা কঠিন সময় পার করছেন। শ্রমিকদের পাশাপাশি পোশাকশিল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের (এসজিএসএফ) সভাপতি নাজমা আক্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
প্রথম আলো: তাজরীনের আহত শ্রমিকেরা আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন করেছেন। তারপর তাঁদের লাঠিপেটা করে এলাকাছাড়া করেছে পুলিশ। শ্রমিকদের এই দুরবস্থার কারণ কী?
নাজমা আক্তার: তাজরীনের আন্দোলনরত আহত শ্রমিকের অনেকেই কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। একজন সুস্থ স্বাভাবিক শ্রমিক ৬০ বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারেন। দুর্ঘটনার পর যখন অর্থসহায়তা দেওয়া হয়েছিল, তখন শ্রমিকদের ৬০ বছর পর্যন্ত কাজের মজুরি হিসাব করা হয়নি। সে কারণে বিপদে পড়েছেন শ্রমিকেরা। প্রতিনিয়ত শ্রম আইনের সংশোধন হচ্ছে। সেগুলো শ্রমিকের পক্ষে আসার পরিবর্তে বিপক্ষে যাচ্ছে। কারণ, মালিকেরা অনেক বেশি ক্ষমতাধর। আড়াই লাখ টাকা দিয়ে একজন পঙ্গু মানুষ কীভাবে তাঁর পরিবার নিয়ে বাঁচবেন। এসব নিয়ে সরকার-মালিক কেউ ভাবেন না।
শ্রমিকদের এই অধিকারের জায়গাটি কে সুরক্ষা করবে?
নাজমা আক্তার: সরকার, নীতিনির্ধারক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শ্রমিক সংগঠনকেই কাজটি করতে হবে। মালিকদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে কোনো লাভ হবে না। রানা প্লাজার যে মালিকদের কারণে নিরীহ শ্রমিকেরা ভবনের নিচে চাপা পড়েছিলেন, তাঁদের আটক করেছিল পুলিশ। তবে তাঁদের ছয় মাসও জেল খাটতে হয়নি। কারণ, তাঁদের সঙ্গে ছিল বিজিএমইএর মতো প্রভাবশালী সংগঠন। বিজিএমইএর নেতারা সেই মালিকদের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছেন। আসলে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠনগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তাঁদের মধ্যে ঐক্য দেখা যায় না।
শ্রমিকনেতাদের একটি অংশ তো মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে...
নাজমা আক্তার: মালিকেরা নিজেদের বিপদে সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সেটি দেখা যায় না। নেতাদের অনেকেরই শ্রমিক অধিকার বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক অধিকার আন্দোলন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ঢালাওভাবে বলব না, তবে অনেক শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে মালিকদের সুরক্ষাটাই বেশি হয়। এতে শ্রমিকস্বার্থের বিসর্জন হয়। শ্রমিকের অধিকার আদায়ে একসঙ্গে জোরালো যে কণ্ঠস্বর তোলা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে না। কেউ করার চেষ্টা করলে তাঁকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে। এটাই হচ্ছে আমাদের ব্যর্থতা।
করোনাকালে মালিকেরা শ্রমিকদের পাশে কতটা দাঁড়ালেন?
নাজমা আক্তার: করোনা মহামারির সময় শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকেরা কী করেছেন, সেটি আপনারা দেখেছেন বা শুনেছেন। করোনা সংক্রমণের শুরুতেই কারখানাগুলো বেআইনিভাবে লে-অফ করেছে। শ্রমিকেরা সময়মতো ন্যায্য মজুরি পাননি। এপ্রিলের মজুরি কম পাওয়ার পর শ্রমিকেরা যখন বাড়িভাড়া কমানোর দাবি করলেন, মালিকেরা বললেন, তা সরকার দেখবে। বাড়িভাড়া কমেনি। মজুরি না দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। বকেয়া মজুরি ও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার জন্য এলাকার গুন্ডা-মাস্তান দিয়ে শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনা ঘটেছে। ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকেরা অন্য কারখানায় চাকরি নিতে গেলে তাঁদের কম মজুরি অফার করা হয়েছে। করোনার আগের চেয়ে কর্মী কমে যাওয়ায় কাজের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে অধিকাংশ কারখানা। কম শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদন করার জন্য কারখানার ভেতরে গালাগালি আর ভয়ভীতি দেখানো বেড়ে গেছে।
মালিকপক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। আপনি কি তাঁদের সঙ্গে একমত?
নাজমা আক্তার: শ্রমিক-মালিকদের সম্পর্ক উন্নতি যে একেবারে হয়নি, সেটি বলব না। পোশাকশিল্পে ৭০০-৮০০ ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন হয়েছে। তবে গুণগত মান বাড়েনি। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা, সামাজিক সংলাপ ও সুস্থ দর-কষাকষির পরিবেশ ১০০টি কারখানায়ও হয়নি। যেদিন এটি ৬০ শতাংশে পৌঁছাবে, সেদিন মালিকদের সঙ্গে একমত হতে পারব।
রানা প্লাজার যে মালিকদের কারণে নিরীহ শ্রমিকেরা ভবনের নিচে চাপা পড়েছিলেন, তাঁদের আটক করেছিল পুলিশ। তবে তাঁদের ছয় মাসও জেল খাটতে হয়নি। কারণ, তাঁদের সঙ্গে ছিল বিজিএমইএর মতো প্রভাবশালী সংগঠন। বিজিএমইএর নেতারা সেই মালিকদের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছেন। আসলে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন।
শ্রমিকদের জন্য কি মালিকপক্ষের আরও কিছু করার ছিল?
নাজমা আক্তার: বিদেশি ক্রেতা ও কারখানার মালিক যে মুনাফা করেন, সেখান থেকে কিছু অর্থ কি শ্রমিকদের জন্য রাখতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। কিন্তু তাঁরা দেবেন না। তাঁরা মনে করেন, শ্রমিকদের যত বেশি চাপে রাখা যাবে, তাঁরা তত বেশি উৎপাদন করবেন।
দেশের বড় বড় কারখানার মালিকেরা যাঁরা বলছেন ব্যবসায় লাভ নেই, তাঁরাই আবার বছর বছর নতুন কারখানা করছেন। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকেই গণমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক, ওষুধ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো ব্যবসায় নেমেছেন। পোশাকের ব্যবসায় মুনাফা না থাকলে তাঁরা কি সেটি করতে পারতেন?
ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে বর্তমানে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে?
নাজমা আক্তার: শ্রমিকেরা যেন ট্রেড ইউনিয়ন না করতে পারেন, সে জন্য ভয়ভীতি দেখানো বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকেরা। স্থানীয় গুন্ডা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়েও শ্রমিকদের হয়রানি করা হয়। যাঁরা ইউনিয়ন করতে চান, জোর করে তাঁদের পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়। ঘুষ দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। আবার মালিকদের পাতানো ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মানে পছন্দের শ্রমিকদের দিয়ে ইউনিয়নও হচ্ছে।
প্রথম আলো: শ্রমিকের মজুরি কম বাড়ানোর জন্য মালিকপক্ষের চিরাচরিত যুক্তি, ক্রেতারা পোশাকের দাম আগের চেয়ে কম দিচ্ছে কিংবা ব্যবসায় মুনাফা কম। এমন বক্তব্য কতটা যৌক্তিক?
নাজমা আক্তার: আমি এই কথার সঙ্গে একমত। ক্রেতারা সস্তা শ্রমের জন্যই বাংলাদেশে আসে। কিন্তু আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, ব্যবসায় যদি কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না হয়, তাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে কেন তাঁরা এই ব্যবসা করছেন। দেশের বড় বড় কারখানার মালিকেরা যাঁরা বলছেন ব্যবসায় লাভ নেই, তাঁরাই আবার বছর বছর নতুন কারখানা করছেন। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকেই গণমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক, ওষুধ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো ব্যবসায় নেমেছেন। পোশাকের ব্যবসায় মুনাফা না থাকলে তাঁরা কি সেটি করতে পারতেন? আসল কথা হচ্ছে, মালিক কিংবা ক্রেতা—কেউই মজুরি বাড়ানোর দায়িত্ব নিতে চান না। উল্টো মজুরি যতটা দমিয়ে রাখা যায়, সেই চেষ্টা করেন তাঁরা। সেটি দিয়েই তাঁরা ব্যবসাটা করতে চান।