বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সাভারের রানা প্লাজার ধস।
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর দেশি-বিদেশি তিনটি পৃথক উদ্যোগে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ শুরু হয়। আন্তর্জাতিক চাপ ও ব্যবসা হারানোর ভয় থাকায় প্রথম পাঁচ বছর সংস্কারকাজ বেশ দ্রুতগতিতে এগোয়। ব্যবসাও ঘুরে দাঁড়ায়। তবে ধীরে ধীরে সংস্কারকাজের গতি হারাতে থাকে। বলতে গেলে সংস্কারকাজ এখন থমকে আছে। চার বছর ধরে এ অবস্থা চলছে।
ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গোটানোর কারণে মাঝারি ও বড় প্রায় দুই হাজার কারখানার সংস্কারকাজে ধাক্কা লাগে। যদিও তার আগেই ৯০ শতাংশের বেশি সংস্কারকাজ শেষ হয়। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অ্যালায়েন্স চলে যাওয়ার পর তাদের অধীনে থাকা কারখানাগুলো তদারকিতে নিরাপন নামে একটি সংস্থা গঠিত হলেও সেটি এখন নেই। আর অ্যাকর্ডের কারখানাগুলো ২০২০ সালের ৩১ মে থেকে তদারকি করছে আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)। জাতীয় উদ্যোগে গঠিত এই সংস্থাটি শুরু থেকেই ধীরে চলছে। মাঝে কিছুদিন পরিদর্শন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। চলতি বছর আবার শুরু হয়েছে। তবে তা সন্তোষজনক নয় বলছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা।
অন্যদিকে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে থাকা ৬৫২ কারখানার সংস্কারকাজ চলছে কচ্ছপগতিতে। সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে কারখানাগুলোর সংস্কারকাজ তদারকি করছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। গত ডিসেম্বরে সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে সংস্কারকাজ অর্ধেকও হয়নি।
পোশাকশিল্পে নতুন করে কোনো দুর্ঘটনায় শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে সংস্কারকাজের সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এখনই।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও এনটিএপির অধীনে থাকা পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ শেষ হয়নি। এই তিন উদ্যোগের বাইরে পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য না হওয়ায় ৬৫৪ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা পরিদর্শন কার্যক্রমের বাইরে ছিল। আবার নতুন নতুন কারখানা হচ্ছে। শিল্প পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুরে চলতি বছরের প্রথম মাসে ৫৭টি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। তার মধ্যে পোশাক কারখানাই বেশি। প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখেছেন, কারখানাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে। কোনো কোনোটিতে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাও নেই।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সাভারের রানা প্লাজার ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া দেশের সবচেয়ে বড় এই শিল্প দুর্ঘটনায় ৫ পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক নিহত হন। সেই শিল্প দুর্ঘটনার ৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ রোববার।
জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার বলেন, মোটাদাগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানায় এখনো অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও বয়লার দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। মালিকপক্ষের গাফিলতি ও সরকার শক্ত পদক্ষেপ না নেওয়ায় কারখানাগুলো শ্রমিকের জন্য নিরাপদ করা যায়নি।
এনটিএপির অধীন ১ হাজার ৫৪৯ পোশাক কারখানার পরিদর্শন ২০১৫ সালের নভেম্বরে শেষ হয়। ওই সময় ডিআইএফই বলেছিল, কারখানাগুলোর কোনোটিই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু বারবার চাপ দিয়েও এসব কারখানার সংস্কারকাজে গতি আনতে ব্যর্থ হয় অধিদপ্তর। পরে সংস্কারকাজ তদারকিতে আরসিসি গঠিত হয়, কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আরএসসির অধীন থাকা ৬৫২ কারখানার ত্রুটি সংস্কারকাজ হয়েছিল ৪৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে আরসিসির মেয়াদ শেষ হয়।
জানতে চাইলে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস দুয়েক আগে কারখানার সংস্কারকাজ শেষ করতে আমরা ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিট গঠন করেছি। সেই ইউনিটে বর্তমানে ৬ জন প্রকৌশলী কাজ করছেন।’ তিনি জানান, সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে ৬৫২ কারখানাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে রয়েছে ১৭২ কারখানা। তার মধ্যে ২০-২২টি বন্ধ। মূলত দ্রুত সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা যায় এমন কারখানাই প্রথমে নেওয়া হয়েছে। ৩০ জুনের মধ্যে কারখানাগুলোর সংস্কারকাজ শেষ হবে। বাকি কারখানার সংস্কারকাজ ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করার পথনকশা রয়েছে।
২০২০ সালের ৩১ মে আরএসসির কাছে কার্যক্রম হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ছাড়ে অ্যাকর্ড। গত ডিসেম্বরে আরএসসি জানায়, তাদের অধীন থাকা ১ হাজার ৬৬২ কারখানার সামগ্রিক সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে সাড়ে ৯১ শতাংশ। যদিও অ্যাকর্ড দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই প্রায় ৯০ শতাংশ সংস্কারকাজ সম্পন্ন করেছিল।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, আরএসসি খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তাদের আরও পেশাদার হতে হবে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার নিরাপত্তায় ভালো অগ্রগতি হয়। তবে কয়েক বছর ধরে সংস্কারকাজ প্রায় থমকে আছে। এতে কারখানায় নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নতুন অগ্নিদুর্ঘটনা জানান দিচ্ছে। তিনি বলেন, পোশাকশিল্পে নতুন করে কোনো দুর্ঘটনায় শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে সংস্কারকাজের সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এখনই।