দেশের বাইরে কদর বাড়ছে কামরুন্নাহারের পাটের জুতার

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একঝাঁক এসএমই উদ্যোক্তা আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে চলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চোখের সামনে কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও ভেঙে পড়েন না, কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদে নিঃস্ব হলেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেন, কেউ কেউ সোনালি আঁশের নবজাগরণের জন্য কাজ করেন। এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ ছয়জন স্বপ্নজয়ী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে ‘আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১’। তাঁদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা শ্রেনীতে পুরস্কার পেয়েছেন নবাবী ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কামরুন্নাহার খানম

নারী উদ্যোক্তা শ্রেনীতে আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১ বিজয়ী নবাবী ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কামরুন্নাহার খানম

দেশের বাইরে কদর বাড়ছে নেত্রকোনার কামরুন্নাহার খানমের নবাবী ফুটওয়্যার কারখানায় তৈরি পাটের জুতার। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় দেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে এই জুতা। বিশেষায়িত ফ্যাশনের জুতা, স্লিপার, স্যান্ডেল তরুণ-তরুণীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।

কামরুন্নাহার খানম ২০১৪ সালের শেষের দিকে নেত্রকোনা শহরের ছোট বাজার এলাকায় ‘নবাবী স্টাইল’ নামের একটি দোকান দেন। তাতে মেয়েদের ব্যাগ, চশমা, অলংকারসহ বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি পাটের জুতা, পাটের সোল এবং লেদার লোফার রাখেন। লক্ষ করেন পাটের জুতা বেশি বিক্রি হচ্ছে। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় তিনি চীনের এক প্রদর্শনীতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন বিদেশেও পাটের জুতার চাহিদা রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেন নিজেই পাটের জুতা তৈরি করে দেশের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করবেন। এরপর নিজের সঞ্চিত অর্থ ও ব্যাংকের সহযোগিতায় মেশিন আমদানি করে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নেত্রকোনায় বিসিক শিল্পনগরীতে বরাদ্দকৃত প্লটে জুতার কারখানা স্থাপন করেন। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে পাটের জুতা তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু দক্ষ কারিগর ও কর্মীর অভাব। সীমান্তবর্তী জেলায় শ্রমিক ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা। ঠিক করলেন নিজেই তাঁদের প্রশিক্ষিত করবেন। আগ্রহীদের পরিণত করলেন দক্ষ শ্রমিকে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ৬৬ জন কর্মী বর্তমানে এই কারখানায় কাজ করছেন।

আইডিএলসি প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১-প্রাপ্ত বিজয়ীরা অতিথিদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেয়। (বা থেকে বসা) পুরস্কারপ্রাপ্ত মো. ওলি উল্লাহ, রেহানা আক্তার, খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, রাজিয়া সুলতানা, মো. মনির হোসেন ও কামরুন্নাহার খানম। (বাঁ থেকে দাঁড়িয়ে) মো. জাকের হোসেন, মির্জা নূরুল গণী শোভন, এম এ মান্নান, এম জামাল উদ্দিন, মুহম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমান ও মতিউর রহমান। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

তাঁর কারখানার উৎপাদিত পাটপণ্য বিশেষ করে জুতার ব্যাপক চাহিদা থাকায় ফ্রান্স, স্পেনে রপ্তানি করা হচ্ছে। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে জুতার পাশাপাশি ব্যাগ, শোপিস, মেয়েদের গয়না, বিভিন্ন ধরনের কভার, ম্যাট, শতরঞ্জি, পরিধেয় ব্লেজার, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারযোগ্য জিনিস তৈরি করছেন।

তাঁর কারখানায় উৎপাদিত জুতা সম্পর্কে কামরুন্নাহার জানান, ‘আমাদের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানি করা জুতার ডিজাইন ক্রেতা নিজে দিয়ে থাকেন। আমরা তাঁদের দেওয়া ডিজাইন অনুযায়ী জুতা তৈরি করি। এ ছাড়া আমরা অনলাইন থেকে ডিজাইন সংগ্রহ করে জুতা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করি।’

কারখানাটিতে পাট ও পাটজাত পণ্যের মধ্যে পাট, পাটের ফেব্রিক ও কর্টনের ফেব্রিক সমন্বয়ে এসব জুতা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া পাটের তৈরি জুতার সোল ও ব্যাগ তৈরি হয়, যা পরিবেশবান্ধব। অন্যদিকে, চামড়ার তৈরি লোফার ও স্যান্ডেল; রাবার সোল, হেক্স ডাম্বেল ইত্যাদি উৎপাদিত হয়।

নবাবী ফুটওয়্যারকে এর প্রতিষ্ঠাকালের অল্পসময়েই কোভিড-১৯ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ইতিমধ্যে দেশের বাজারের ওপরও নজর দেওয়া হচ্ছে।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মেলাসমূহে অংশগ্রহণ করছে নবাবী ফুটওয়্যার। এর মধ্যে তুরস্কের ইস্তাম্বুল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই উল্লেখযোগ্য।

কামরুন্নাহার খানম নবাবী ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পাশাপাশি ইমপ্রুভ অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, ইমপ্রুভ মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, নবাবী স্টাইলের সমন্বয়ে গঠিত ইমপ্রুভ গ্রুপের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নেত্রকোনা নাসিব মহিলা উদ্যোক্তা কাউন্সিলের সভাপতি, বিসিক শিল্প মালিক সমিতি, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সমিতি নেত্রকোনা জেলার সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এর মাধ্যমে এলাকার নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৯ সালের প্রথম জাতীয় শিল্প মেলায় অংশগ্রহণ ও শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০১৯’ অর্জন, ময়মনসিংহ বিভাগীয় ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২০’ অর্জন করেন।

কামরুন্নাহার নবাবী মনে করেন, যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে পাটের আরও বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব। পাটপণ্য যেহেতু পরিবেশবান্ধব তাই বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। কামরুন্নাহার বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের বহুমুখী পাটপণ্য আবারও পৃথিবী জয় করতে পারবে।