গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস–সংকট চলছে। যে কারণে বাসাবাড়িতে যেমন চুলা জ্বলছে না, তেমনি শিল্পকারখানায়ও উৎপাদন চলছে না।
পবিত্র রমজানের প্রথম দিন রোববার থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস–সংকট চলছে। যে কারণে বাসাবাড়িতে যেমন ইফতারি ও সাহ্রি তৈরিতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে, তেমনি শিল্পকারখানায়ও উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে বিদু৵তের লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বিভিন্ন শিল্পকারখানার মালিক ও কর্মকর্তাদের দাবি, প্রতি বর্গফুটে যেখানে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা, সেখানে অনেক কারখানায় তা কমে মাত্র ২–৩ পিএসআইতে নেমে এসেছে। আবার কোনো কোনো কারখানায় পিএসআই শূন্যতে নেমে গেছে। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে আর্থিকভাবে লোকসানে পড়ার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদামতো দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক সরবরাহ করতে না পারলে তারা ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেবেন এবং বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়বেন।
কাশিমপুর এলাকার জব্বার ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক খায়রুল ইসলাম জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ কোনোভাবেই ৫-৬ পিএসআইয়ের ওপরে উঠছে না। তবে বেশিরভাগ সময়ই তা ৩-৪ এর মধ্যে থাকে। এতে কারখানায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় গাজীপুর মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় লাখ লাখ মানুষের বাসাবাড়িতেও চুলা জ্বলছে না। এতে তাঁরা চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার জয়দেবপুরের আওতায় ৬১০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ২৫০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকে।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মোশাররফ নিট কম্পোজিট লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের কারখানা অনেক দিন ধরেই গ্যাস সংকটে রয়েছে। বারবার অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আরও খারাপ অবস্থা। যেখানে গ্যাসের চাপ থাকার কথা ১৫ পিএসআই, সেখানে তা শূন্য হয়ে আছে। যে কারণে পালা করে কারখানার অর্ধেক অংশ সব সময় বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ৫০ ভাগ কমে গেছে। এখন পিবিএস ও ডিজেল জেনারেটর দিয়ে যতটুকু সম্ভব, ততটুকুই চালানো হচ্ছে।
চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ব্যবসায়ী হাশেম সরকার জানান, গ্যাসের সমস্যার কারণে তাঁর এলাকার সবাই বিপাকে পড়েছেন।
তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা জানান, রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের ছয়টি কূপ থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দেশে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে গাজীপুরের সিএনজি স্টেশনগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশ না মানায় সোমবার (গতকাল) গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার জেরোমা, হাজি ওয়াহেদ সরকার ও প্রগ্রেসিভ নামের তিনটি সিএনজি স্টেশন বন্ধ করে করে দেওয়া হয়েছে।
নগরের লক্ষ্মীপুরা এলাকার স্প্যারো অ্যাপারেলসের জিএম শরিফুল রেজা জানান, তীব্র গ্যাস-সংকট থাকায় তাঁদের কারখানায় দুটি বয়লার চালাতে মুশকিল হচ্ছে। বয়লার সচল রাখতে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ডিজেল কিনতে হয়। কারখানায় প্রতিদিন যেখানে ১০ হাজার প্যান্ট উৎপাদনের লক্ষ্য থাকে, সেখানে এখন ৪ থেকে ৫ হাজারটি উৎপাদন করা যায়। তাই বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পোশাক সরবরাহ করতে শ্রমিকদের দিয়ে ওভারটাইম করাতে হচ্ছে। এভাবে শ্রমিকদের ওভারটাইম করানোর (অতিরিক্ত সময়ে কাজ করানো) কারণে দিনে তিন–চার লাখ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাঁরা ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন বলে জানান।
একই এলাকার পোশাক কারখানা খান ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হযরত আলী বলেন, বারবার গ্যাসের চাপ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। সুরাহা আর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের হাতে কিছু নেই, প্রাকৃতিক সমস্যা। অন্য কারখানা মামুন স্পিনিংয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সৈকত হোসেন জানান, গ্যাসের চাপ কম থাকায় গত কয়েক মাস ধরে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ১৫ ভাগ ক্ষতির মুখে রয়েছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের জয়দেবপুর শাখার ব্যবস্থাপক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবেই গ্যাস না পাওয়ায় সরবরাহ কমেছে। তাই শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে প্রতিদিন শত শত অভিযোগ আসছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে তা বলা যাচ্ছে না।