পাঁচ দিন পর কোরবানির ঈদ। পশুর হাটে হাঁকডাক শুরু হয়েছে। বেচাবিক্রি জমে উঠতে শুরু করেছে। যদিও ব্যবসায়ীরা পশুর দাম ছাড়ছেন না। ক্রেতারাও যাচাই–বাছাই করছেন। তবে তার আগেই রেফ্রিজারেটরের বাজার জমে উঠেছে। ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানে ঢুঁ দিলেই বিষয়টি আঁচ করা যাচ্ছে।
রেফ্রিজারেটর ছাড়া ব্যস্ত নগরজীবন এক মুহূর্ত চিন্তা করা যায় না। কোরবানির ঈদ এলে এই যন্ত্রের উপযোগিতা আরেক ধাপ বেড়ে যায়। এ উপলক্ষে অনেকেই পুরোনো রেফ্রিজারেটর বদলে নেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যন্ত্রটির বিক্রি বেশ বাড়ে। চলতি বছর নানা কারণে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফ্রিজের দাম কিছুটা বেড়েছে। তারপরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফ্রিজ বিক্রির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
দেড় দশক আগেও ফ্রিজ ছিল উচ্চ ও মধ্য আয়ের মানুষের শখের পণ্য। চাহিদার পুরোটাই তখন আমদানি হতো বিভিন্ন দেশ থেকে। সে কারণে দামও ছিল বেশি। ২০০৮ সালে দেশে ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে ওয়ালটন। আমদানি করা ফ্রিজের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে সরবরাহ করায় পণ্যটি অনেকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। তখন আরও কিছু কোম্পানি উৎপাদনে আগ্রহ দেখায়। সরকারও নীতিসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে ফ্রিজ আমদানি কমতে থাকে। দেশের বাজারে দাপট বাড়তে থাকে দেশীয় ব্র্যান্ডের।
দেশে ফ্রিজের বাজারের আকার কত বড়—সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য–উপাত্ত খুব বেশি নেই। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে বছরে কমবেশি প্রায় ৩০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছর ১৫–২০ শতাংশ হারে ব্যবসা বাড়ছে। সব মিলিয়ে সারা বছর যে পরিমাণ রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয়, তার ৩০–৪০ শতাংশ হয় কোরবানির ঈদের আগে।
মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ (এমডব্লিউবি) গত বছরের মার্চে এক গবেষণায় বলেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে ফ্রিজের বাজার হিস্যার ৭৭ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। আর গত বছর ফ্রিজের বাজারের আকার প্রায় ৬৮ কোটি ডলার। চলতি বছর সেটি বেড়ে ৮৮ কোটি ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দিয়েছিল এমডব্লিউবি।
দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ওয়ালটন। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ওয়ালটন ইলেকট্রনিকসের বাজারে যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালের শেষের দিকে তারা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা গড়ে তোলে। সেই কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। বর্তমানে ওয়ালটনের ফ্রিজের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৪২ লাখ ইউনিট। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কম্প্রেসর উৎপাদন শুরু করে।
জানতে চাইলে ওয়ালটনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ফিরোজ আলম বলেন, নানা ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। জ্বালানির দামও বাড়তি। এর মধ্যে করোনা ছিল অনেক দিন। এখন আবার সারা দেশে বন্যার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিক যে ব্যবসা, তাতে কিছুটা হলেও ব্যাঘাত ঘটছে। এরপরও ব্যবসা যেটি হচ্ছে, সেটি খারাপ না। এখন দেশের ফ্রিজের বাজারের সিংগভাগই ওয়ালটনের দখলে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। তার সঙ্গে কাঁচামালের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান চাপে পড়েছে। তাতে প্রতিষ্ঠানভেদে ফ্রিজের দাম ৫–২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ফ্রিজের বাজারে নবাগত দেশীয় ব্র্যান্ড ওরিয়ন। গত বছরের শুরুতে বাজারে পণ্য নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা তিন লাখ ইউনিট ফ্রিজ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ওরিয়ন হোম অ্যাপ্লায়েন্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. আবু তারিক জিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বর্তমানে ৪০টি মডেলের ফ্রিজ উৎপাদন করছি। আমরা কোরবানির ঈদে প্রায় ১৫ হাজার ইউনিট ফ্রিজ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি। ইতিমধ্যে ডিলার পর্যায়ে বিক্রি শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি জমে উঠবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা যে দামে ফ্রিজ দিতে পারছিলাম, সেই দামে হয়তো আর দিতে পারব না। কারণ, খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ঈদের পর আমরা দাম সমন্বয় করব।’
ট্রান্সকম ডিজিটাল বর্তমানে নিজেদের ট্রান্সটেক ব্র্যান্ড ছাড়াও স্যামসাং, হিটাচি, ওয়ার্লপুল ও প্যানাসনিক ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বিক্রি করছে। কোরবানি উপলক্ষে ফ্রিজের ক্রেতাদের আকর্ষণীয় গিফট বক্স দিচ্ছে তারা। এ ছাড়া লঙ্কাবাংলা ও ব্যাংক এশিয়ার কার্ডে ফ্রিজ কিনলে মূল্যছাড় দিচ্ছে ট্রান্সকম ডিজিটাল।
জানতে চাইলে ট্রান্সকম ডিজিটালের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মাহবুব হাসান বলেন, ‘কোরবানির ঈদের ১–২ মাস আগ থেকেই ফ্রিজের বিক্রি বাড়ে। এবারও সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আশা করছি, কোরবানির ঈদে আমাদের ফ্রিজের বিক্রি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাহকদের কথা চিন্তা করে আমরা খুবই সামান্য দাম বৃদ্ধি করেছি। বেশ কিছু মডেলের দাম আমরা বৃদ্ধি করিনি।’
এমডব্লিউবির গবেষণার তথ্যানুযায়ী, দেশে তিন ধরনের ফ্রিজ বিক্রি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফ্রস্ট ফ্রিজের বাজার হিস্যা ৮৫ শতাংশের মতো। ননফ্রস্ট ৮ দশমিক ৩৩ এবং চেস্ট বা ডিপ ফ্রিজ ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মতো বিক্রি হয়।
স্যামসাং ও ইলেক্ট্রা ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বাজারজাত করছে ইলেক্টা ইন্টারন্যাশনাল। এবারের কোরবানির ঈদে ১০ হাজার ইউনিট ফ্রিজ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মো. মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ফ্রিজের দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। বাড়তি দামের কারণে গতবারের মতো ভালো বিক্রি না–ও হতে পারে। তারপরও আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রার ৬০–৭০ শতাংশ অর্জন সম্ভব হবে।’
ফ্রিজের বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম যমুনা ইলেকট্রনিকস। ২০১৪ সাল থেকে যমুনা ব্র্যান্ড নামে ফ্রিজ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। জানতে চাইলে যমুনা ইলেকট্রনিকসের বিপণন বিভাগের পরিচালক সেলিম উল্যা সেলিম বলেন, ‘চলতি বছরের মধ্যে আমরা ৩০০টি ফ্ল্যাগশিপ বিক্রয়কেন্দ্র করতে চাই। যাতে শহর থেকে মফস্বল—সব জায়গার ভোক্তাদের কাছেই আমরা পৌঁছাতে পারি।’
দেশীয় ফ্রিজের বাজারে আরেক ব্র্যান্ড মিনিস্টার। তারা ২১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকার ফ্রিজ বিক্রি করছে। তাদের এক্সচেঞ্জ অফারও রয়েছে। যার মাধ্যমে গ্রাহকেরা পুরোনো ফ্রিজ বদলে নিতে পারেন নতুন পণ্য। সঙ্গে রয়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়।
জানতে চাইলে মিনিস্টার গ্রুপের হেড অব ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন সোহেল কিবরিয়া বরেন, মিনিস্টারের প্রতিটি ফ্রিজে যুক্ত করা হয়েছে এমন সব প্রযুক্তি যা সঠিক তাপমাত্রা, হিমায়িত খাবারের ভিটামিন এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে। সম্পূর্ণ অটোমেটিকভাবে ফ্রিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ফ্রিজ।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, সরকারের নীতিসহায়তার কারণে ফ্রিজের বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ভিত শক্ত হয়েছে। আগামী কয়েক বছর সেটি অব্যাহত রাখলে ফ্রিজের রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে।