রাসায়নিক শিল্পপার্ক

কে সরাল বিসিকের মাটি

নিমতলী থেকে রাসায়নিক কারখানা সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এখনো ভূমি উন্নয়নের কাজই শেষ করতে পারেনি বিসিক।

বিসিকের লোগো
ছবি: সংগৃহীত

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার তুলসীখালী এলাকায় নির্মাণাধীন রাসায়নিক শিল্পপার্কের ৩১০ একর জমি ৬ দশমিক ২ মিটার (১৮ দশমিক ৬ ফুট) উচ্চতা পর্যন্ত মাটি ভরাট করা হয়েছিল। সেখানে এখন মাটির উচ্চতা মিলছে ৫ দশমিক ২ মিটার। অর্থাৎ ১ মিটার (৩ ফুট) মাটির কোনো হদিস নেই।

চাঁদপুর থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে মেঘনা ও পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে আনা এত মাটি কোথায় গেল বা কে চুরি করল, সে সম্পর্কে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কোনো কর্মকর্তাই কিছু বলতে পারছেন না। অবশ্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশ ছাড়া এলাকা থেকে মাটি সরানো অসম্ভব।

এই রাসায়নিক শিল্পপার্ককে বন্যামুক্ত রাখতে হলে পুরো ৩১০ একর জায়গা মাটি ফেলে আবার এক মিটার উঁচু করতে হবে। এ জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বাড়তি ১০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।

রাসায়নিক শিল্পপার্কটি থেকে বিপুল পরিমাণ মাটি হাওয়া হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি অনলাইনে প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় উঠে আসে। শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিসিকের চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমানসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন।

ওই সভার সূত্র ধরে মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসন, বিসিকের প্রকল্প পরিচালকের অফিস ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, কারা মাটি সরিয়েছে, তা এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিসিক চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

প্রকল্প এলাকার পাশে ইটভাটা আছে। রাতের আঁধারে ইটভাটায় মাটি নিয়ে গেছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।
হাফিজুর রহমান , প্রকল্পের পরিচালক, বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক

‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ নামের এই প্রকল্পের পরিচালক হাফিজুর রহমান প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, প্রকল্প এলাকায় ফেলা এক মিটারের মতো মাটির হিসাব মিলছে না। তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকার পাশে ইটভাটা আছে। রাতের আঁধারে ইটভাটায় মাটি নিয়ে গেছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।

২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানির পর সেখান থেকে সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরই সব রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জায়গায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় বিসিক। কিন্তু ওই পরিমাণ জায়গায় প্রচুরসংখ্যক কারখানা স্থানান্তর করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে প্রকল্পটি মুন্সিগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় ২০১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এক লাফে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকায় ওঠে। অর্থাৎ খরচ ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা বা আট গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।

জানা গেছে, এখন নতুন করে জমি ভরাটের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা লাগবে। পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদও আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করতে চলেছে বিসিক। এ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নতুন করে ভূমি উন্নয়নের জন্য দরপত্র আহ্বান করতে হবে। সে জন্য বাড়তি সময় লাগবে। টাকারও প্রয়োজন হবে।’

পুরো প্রকল্প এলাকায় মোট ৪৩ লাখ বর্গমিটার মাটি ফেলার কাজটি পেয়েছিল ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন রাসায়নিক শিল্পপার্কের জন্য ২০২০ সালে বিসিককে সিরাজদিখান উপজেলার তুলসীখালী সেতুসংলগ্ন এলাকায় ৩১০ একর জমি বুঝিয়ে দেয়।

প্রকল্পটির শুরু থেকেই অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের মার্চে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তৎকালীন সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সরেজমিনে প্রকল্পটি দেখতে যান। তখন তিনি দেখতে পান, প্রকল্প পরিচালক সেখানে মাসিক ৮০ হাজার টাকা ভাড়ায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের একটি অফিস ভাড়া নিয়েছেন। একই পরিমাণ টাকায় একটি গাড়িও ভাড়া করেছেন তিনি। প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, অপ্রয়োজনে বিশাল অফিস ও গাড়ি ভাড়া নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

এ ঘটনায় বিসিক দায় এড়াতে পারে না, কারণ তারা কাজ বুঝে পাওয়ার পর টাকা পরিশোধ করেছে। এখন যদি তারা বলে মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, তার দায়ভার তাদের। মাটি সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ঘটনা তদন্তে বিসিকের একজন পরিচালককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত করেছে সংস্থাটি।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গত রাতে বলেন, এ ঘটনায় বিসিক দায় এড়াতে পারে না, কারণ তারা কাজ বুঝে পাওয়ার পর টাকা পরিশোধ করেছে। এখন যদি তারা বলে মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, তার দায়ভার তাদের। মাটি সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।