লকডাউন, চাহিদা হ্রাস ও কাঁচামালের সরবরাহে ব্যাঘাতের কারণে বছরের প্রথম ছয় মাসে এশিয়ার দেশগুলোর পোশাক রপ্তানি ৭০ শতাংশ কমেছে।
করোনার আগের তুলনায় পরের মাসগুলোতে বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ পোশাক কারখানা ৫০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
করোনার কারণে বাংলাদেশের মতো কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম—এসব দেশেও পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত, লে-অফ, ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস ও মজুরি প্রদানে বিলম্ব ঘটেছে।
করোনার কারণে বাংলাদেশের মতো কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম—এসব দেশেও পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত, লে-অফ, ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস ও মজুরি প্রদানে বিলম্ব ঘটেছে। লকডাউন, চাহিদা হ্রাস ও কাঁচামালের সরবরাহে ব্যাঘাতের কারণে বছরের প্রথম ছয় মাসে এশীয় দেশগুলোর পোশাক রপ্তানি ৭০ শতাংশ কমেছে।
করোনার আগের তুলনায় পরের মাসগুলোতে বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ পোশাক কারখানা ৫০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ কারখানা ৩০-৩৯ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন পরিচালনা করছে। আবার জুলাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রামের অধীনে থাকা আড়াই শ কারখানার ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৯ জন পোশাকশ্রমিক কাজে যোগ দিতে পারেননি, যা কারখানাগুলোর মোট শ্রমিকের ৪১ শতাংশ।
আইএলওর গতকাল বুধবার প্রকাশিত ‘এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের পোশাকশ্রমিক ও কারখানার ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে গত বছর ৬ কোটি ৫০ লাখ পোশাকশ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বিশ্বের পোশাকশ্রমিকের ৭৫ শতাংশই এই অঞ্চলের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশে এপ্রিলের প্রথম তিন সপ্তাহ অধিকাংশ পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। মে মাসে মাত্র ৩ দশমিক ৯ শতাংশ কারখানা সব কর্মীকে নিয়ে উৎপাদন শুরু করে। বাকিরা কম শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন চালু করে। সে সময় কারখানা লে-অফ ঘোষণা ও শ্রমিক ছাঁটাই ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, জুলাইয়ের পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। লকডাউনের পর ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানাগুলো উৎপাদন চালালেও বর্তমানে সেটি বেড়েছে। ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি না পেলে কারখানায় নতুন শ্রমিক নিয়োগ হবে না। ছাঁটাইও হবে না।
সাধারণ পোশাকের চাহিদা কমলেও করোনায় মাস্কের রপ্তানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইইউ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে চীন থেকে ২ হাজার ৯০০ কোটি এবং ভিয়েতনাম থেকে ৯৯ কোটি ডলারের বস্ত্র ও মাস্ক আমদানি করেছে।
করোনায় পোশাকের চাহিদা কমেছে। লকডাউনের কারণে ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এ জন্য চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা ২৬ শতাংশ পোশাক আমদানি কমিয়েছেন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়েছেন যথাক্রমে ২৫ ও ১৭ শতাংশ। এই তিন দেশ ও অঞ্চল বিশ্বের মোট পোশাকের ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ আমদানি করে থাকে।
তবে সাধারণ পোশাকের চাহিদা কমলেও করোনায় মাস্কের রপ্তানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইইউ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে চীন থেকে ২ হাজার ৯০০ কোটি এবং ভিয়েতনাম থেকে ৯৯ কোটি ডলারের বস্ত্র ও মাস্ক আমদানি করেছে। তাতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চীন ও ভিয়েতনামের মাস্কের রপ্তানি বাড়ে যথাক্রমে ৭০৮ ও ২৯৭ শতাংশ। বাংলাদেশের মাস্ক রপ্তানিও শতভাগ বৃদ্ধি পায়। তবে শ্রীলঙ্কার মাস্ক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৭০০ শতাংশ।
করোনায় সব দেশেরই পোশাকের ক্রয়াদেশ কম-বেশি বাতিল হয়েছে। গত মে মাসে চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ ৩০ দেশের ১৭৯ সরবরাহকারীর ওপর পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী ৬৪ শতাংশ পোশাক কারখানাই ক্রয়াদেশ বাতিলের মুখে পড়েছে। আবার চলমান ক্রয়াদেশে ক্রেতা ২০ শতাংশের বেশি মূল্যছাড় চেয়েছে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে ৩৫ শতাংশ কারখানার।
বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম বাংলাদেশের ২৫০ কারখানার ওপর জরিপ চালায়। তাতে উঠে আসে, ৩৮ শতাংশ কারখানা ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল হওয়ার মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে ৩৪ শতাংশ কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছিল। আর ইন্দোনেশিয়ার ২১৬ কারখানার ২৮ শতাংশই ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিতাদেশের মধ্যে পড়েছিল। এর মধ্যে ১৮ শতাংশের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়।
শুধু ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত নয়, পোশাকের দাম পরিশোধেও বাড়তি সময় চায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। আইএলওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ পরিশোধের সময় ৪৫ দিন বাড়ানোর অনুরোধ পায় ৫৭ শতাংশ কারখানা।
করোনার শুরুতে কারখানাগুলো শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেছিল। এখনো তা বন্ধ হয়নি, প্রায়ই ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে। নতুন নিয়োগও প্রায় বন্ধ। ফলে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শ্রমিকের দুঃখ-দুর্দশা কমেনি।শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার
করোনায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের পোশাকশ্রমিকেরা দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত কাজ করতে পারেননি। তাতে তাঁদের আয় কমেছে। সময়মতো মজুরিও পাননি শ্রমিকেরা। লকডাউন শেষে কারখানার উৎপাদন শুরু হলে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৩ জন কাজের জন্য ডাক পান।
বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে কারখানা বন্ধকালে ৬৫ শতাংশ মজুরি পান শ্রমিকেরা। ওই মাসে শ্রমিকেরা গড়ে ৯ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি পেলেও পরের মাসে পান ৫ হাজার ৫২২ টাকা। ভারতের শ্রমিকদের মজুরি কমেছিল ৫৭ শতাংশ। কম্বোডিয়ায় মে ও জুন মাসে শ্রমিকদের মজুরি কমেছিল ৪৯ শতাংশ। প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের হিসাব সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে ৩১৯ থেকে ৫৭৮ কোটি ডলারের মজুরি হারিয়েছেন।
শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার বলেন, করোনার শুরুতে কারখানাগুলো শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেছিল। এখনো তা বন্ধ হয়নি, প্রায়ই ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে। নতুন নিয়োগও প্রায় বন্ধ। ফলে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শ্রমিকের দুঃখ-দুর্দশা কমেনি।