করোনার দুঃসময়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগের সুযোগ নিয়েছেন। একের পর এক জাহাজ কিনে পানিতে ভাসিয়েছেন উদ্যোক্তারা। গত দুই বছরে সাময়িক ও স্থায়ী নিবন্ধন নেওয়া জাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২। তাতে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে।
নৌ বাণিজ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাময়িক নিবন্ধনসহ এখন বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ৮০। এ সংখ্যা স্বাধীনতার পর যেকোনো সময়ে সর্বোচ্চ। এর আগে বাংলাদেশের বহরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল ২০১২ সালে। সে সময় ৬৮টি জাহাজে বাংলাদেশের পতাকা ছিল।
মূলত করোনার সময় জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে বেশি। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছর সাময়িক নিবন্ধনসহ সমুদ্রগামী জাহাজ নিবন্ধন হয়েছে ১৮টি। ২০২০ সালে নিবন্ধন হয় ১৪টি। সব মিলিয়ে করোনার সময় দুই বছরে ৩২টি জাহাজের নিবন্ধন হয়েছে।
করোনার সময়ে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জাহাজ পানিতে ভাসিয়েছে মেঘনা গ্রুপ। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের হিসেবে, গত ২ বছরে ১০টি জাহাজ পানিতে নামিয়েছে গ্রুপটি। তাদের বহরে এখন জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সহসভাপতি ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এ খাতে সরকারের নীতিসহায়তা আগের চেয়ে বেশি। এতে করোনার ঝুঁকির সময়ও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। তবে দেশীয় জাহাজে পণ্য পরিবহন ভাড়া বাবদ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, তা থেকে কর কেটে না নিয়ে প্রণোদনা দেওয়া উচিত। তাহলে উদ্যোক্তারা আরও এগিয়ে আসবেন।
করোনার শুরুতে সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা ব্যবসায় দুঃসময় নেমে আসে। সে সময় বিশ্বের অনেক শিপিং কোম্পানি নিজেদের বহরে থাকা জাহাজ বিক্রি করে দেন। জাহাজের দামও কমে যায়। ঠিক সেই দুঃসময়ে জাহাজ কিনে পানিতে ভাসাতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
করোনার ঝুঁকির সময় এ খাতে বিনিয়োগ করলেও হতাশ হতে হয়নি উদ্যোক্তাদের। কারণ, করোনার ধাক্কা সামলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকায় এ বছরের শুরুর দিক থেকে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া বাড়তে থাকে। এখন সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যায়। এতে যাদের বহরে এখন জাহাজ আছে, তাদের পণ্য পরিবহন বাবদ আয়ও বাড়ছে। এতে দুঃসময়ে ব্যবসায়ীরা যে বিনিয়োগ করেছেন, তা এখন উঠিয়ে আনতে সময় কম লাগবে।
সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বিনিয়োগ করলে মূলত তিন ধরনের সুফল পাওয়া যায়। যেমন এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় দেশীয় নাবিকদের কর্মসংস্থান বাড়ছে। পণ্য পরিবহন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ছে। আবার নিজেদের পণ্য পরিবহন করেও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হচ্ছে।
দেশীয় পতাকাবাহী সবচেয়ে বেশি জাহাজ রয়েছে চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর চারটি জাহাজ কিনে পানিতে ভাসিয়েছে। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বহরে জাহাজের সংখ্যা ২৩টিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৫ সালে এ খাতে প্রথম বিনিয়োগ করে গ্রুপটি।
দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যার ভিত্তিতে মেঘনা গ্রুপের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। গ্রুপটির বহরে থাকা মোট ১৫টি জাহাজের সব কটিই সুপরাম্যাক্স আকারের। সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে তৃতীয় অবস্থানে আছে আকিজ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে চারটি জাহাজের নিবন্ধন নিয়েছে। এ নিয়ে আকিজের বহরে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০।
এক দশক পর করোনার দুঃসময়ে কনটেইনার জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে। ২০২০ সালে ১১৬ কোটি টাকায় দুটি কনটেইনার জাহাজ কিনে এ খাতে ব্যবসা শুরু করেছে কর্ণফুলী লিমিটেড। এ বছর চারটিসহ গ্রুপটির বহরে এখন জাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬।
বসুন্ধরা গ্রুপ এলপিজিবাহী জাহাজে বিনিয়োগ করেছে। এলপিজি পরিবহনের জন্য গ্রুপটির বহরে রয়েছে তিনটি জাহাজ। এ ছাড়া বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের বহরে রয়েছে একটি সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিপিং কোম্পানি বিএসসির বহরে আটটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি নতুন। হানিফ মেরিটাইম লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে নতুন যুক্ত হয়েছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন পণ্য পরিবহনের উপযোগী একটি জাহাজ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে কোম্পানিটি।
জাহাজের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা নৌ বাণিজ্য কার্যালয়ের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার জাহাজ নিবন্ধনে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। নিয়মকানুন সহজ হয়েছে। দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ সুরক্ষায় নতুন আইন হয়েছে। এতে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশি জাহাজের সংখ্যায় এখন রেকর্ড হয়েছে।