রাষ্ট্রীয় মুঠোফোন কোম্পানি টেলিটক গতকাল রোববার দেশে প্রথমবারের মতো পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভ-জি) নেটওয়ার্ক সেবা চালু করেছে। এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের বেশির ভাগ বিটিএসের (বেইস ট্রানসিভার স্টেশন) অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সেবা দিচ্ছে হুয়াওয়ে। আগামী দিনে দেশে ফাইভ-জির বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অবকাঠামো নির্মাণেও ভূমিকা রাখবে হুয়াওয়ে। এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা (সিটিও) কেভিন স্যু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইশতিয়াক মাহমুদ।
প্রথম আলো: প্রযুক্তিগত সুবিধা পাওয়ার দিক থেকে ফোর-জি ও ফাইভ-জির মধ্যে পার্থক্য কী?
কেভিন স্যু: ফোর-জি ও ফাইভ-জির মধ্যে মূল পার্থক্য ইন্টারনেটের গতির। ফাইভ-জি সেবায় ইন্টারনেটের গতি ফোর-জির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। মুঠোফোন সংযোগদাতা বা অপারেটরের ব্যবহৃত তরঙ্গের (স্পেকট্রাম) ওপর নির্ভর করে এক জিবিপিএসেরও (প্রতি সেকেন্ডে ১ গিগাবিট) বেশি গতিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ মিলবে। ডেটা আদান-প্রদানের বিলম্বের সময় নেমে আসবে ১০ মিলি সেকেন্ডে। তবে সব স্মার্টফোনে এ প্রযুক্তি কাজ করে না। ফাইভ-জি প্রযুক্তি সমর্থন করে এমন স্মার্টফোন ও যন্ত্রেই কেবল এ সুবিধা পাওয়া যাবে।
টেলিটকের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ফাইভ-জি সেবা চালু হলো। এতে কারিগরি সহযোগী হিসেবে রয়েছে হুয়াওয়ে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
কেভিন স্যু: টেলিটকের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমরা খুব আনন্দিত। ভবিষ্যতে ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টেলিটকের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক স্থাপনেও সহযোগী হিসেবে কাজ করবে হুয়াওয়ে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুঠোফোন অপারেটরের সংখ্যা প্রায় ৭০০। ফাইভ-জি দিচ্ছে ১৮৩টি, যার মধ্যে ৮০টির বেশি হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ফাইভ-জির প্রযুক্তিপণ্য ও সেবার উন্নয়নে ২০০৯ সাল থেকেই গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) কার্যক্রম চালাচ্ছে হুয়াওয়ে। এ জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি মার্কিন ডলার। নিজেদের গবেষণা-তথ্য কাজে লাগিয়ে শুধু পণ্যই নয়, ফাইভ-জি প্রযুক্তির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে হুয়াওয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ফাইভ-জি প্রযুক্তিনির্ভর প্যাটেন্টগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশ আমাদের দখলে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আমাদের প্রযুক্তিসেবা অনেক বেশি কার্যকর হওয়ায় চীনের পাশাপাশি ইউরোপেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে হুয়াওয়ে। আমরা এরই মধ্যে সিক্স-জি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি।
বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া ফাইভ-জির গতি কি আন্তর্জাতিক মানের?
কেভিন স্যু: আমাদের প্রযুক্তিপণ্য কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ মেগাহার্টজে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করা সম্ভব। যদিও বাংলাদেশের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক পরিচালনায় ব্যবহার করা হচ্ছে ৬০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। ফাইভ-জি চালুর জন্য ১০০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি হলে ভালো হয়। তবে ন্যূনতম ৬০ থেকে ৮০ মেগাহার্টজ কাজে লাগিয়েও এ সেবা দেওয়া যায়। ভবিষ্যতে দেশে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়লে আরও দ্রুতগতির সেবা পাওয়া যাবে।
ফাইভ-জির মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হবে?
কেভিন স্যু: ফাইভ-জি ব্যবহারের মাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বাংলাদেশে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফলে সময় ও পরিচালন ব্যয় কমবে। দেশের শিল্প খাতে ডিজিটালাইজেশনের গতি বাড়বে। শিল্প খাতে এই সেবা ব্যবহারের জন্য সবার আগে কলকারখানায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা বা যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের সংযোগ (মেশিন টু মেশিন কানেকটিভিটি) প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ জন্য ব্যবহার করতে হবে ফাইভ-জি সমর্থিত মুঠোফোন বা যন্ত্র, যা ব্যয়বহুল। শুধু তা-ই নয়, এই প্রযুক্তি পুরোপুরি ব্যবহারের বিষয়টি মুঠোফোন সংযোগদাতার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এ জন্য ফাইভ-জি প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, মুঠোফোন অপারেটর, ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
বাণিজ্যিকভাবে সেবাটি চালু হলে শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, পুরো সমাজেই পরিবর্তন আসবে। পরিচালনার পাশাপাশি শিল্পকারখানার বিভিন্ন যন্ত্র দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
ফাইভ-জি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কী ধরনের ভূমিকা রাখবে?
বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার খুবই ভালো। তবে ফাইভ-জি সেবা পরিচালনার ক্ষেত্রে গ্রাহকসংখ্যার অবস্থানের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ একই স্থানে বেশিসংখ্যক ব্যবহারকারী থাকার ওপর ফাইভ-জির গতি নির্ভর করে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গ্রাহকসংখ্যা বিবেচনা করে বিটিএসের সক্ষমতা বাড়ালে ভালো গতি পাওয়া যাবে। আগামী দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হুয়াওয়ের কারিগরি সেবা নিয়ে বেশির ভাগ বিটিএস বসাবে টেলিটক। ঢাকাসহ প্রত্যন্ত এলাকায় ফাইভ-জি কাজে লাগিয়ে উন্নত বিশ্বের মতো বিভিন্ন প্রযুক্তিসেবা ব্যবহার করা যাবে, যা দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে।