১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা চান মন্ত্রীরা। আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের। তবে পরিকল্পনামন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী ছাড়া সরকারের অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প হলে সেই প্রকল্প অনুমোদনের একমাত্র ক্ষমতা পরিকল্পনামন্ত্রীর। আর ৫০ কোটি টাকার ওপরে প্রকল্প ব্যয় হলে সেই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক), যে কমিটির চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু জরুরি প্রয়োজনের যুক্তি তুলে ধরে বেশ কিছু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, পরিকল্পনামন্ত্রীর পাশাপাশি অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দিতে হবে। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর যুক্তি হলো—এখন যে প্রক্রিয়ায় প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়, তা বেশ সময়সাপেক্ষ। কোনো মন্ত্রণালয়ে জরুরি প্রয়োজনে প্রকল্প নেওয়া হলে সেটি অনুমোদন পেতে পেতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। তখন আর ওই প্রকল্পের গুরুত্ব থাকে না। তাই পরিকল্পনামন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রীর ক্ষমতা ৫০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ কোটি টাকা করার প্রস্তাবও করেছে অন্য মন্ত্রণালয়গুলো।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় যেসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়, তা ‘সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন’ পরিপত্রের নিয়মকানুনের আলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে সর্বশেষ এই পরিপত্র সংশোধন করা হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ায় চার বছর পর এখন নতুন করে পরিপত্রটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
সূত্র জানায়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পরিপত্রে নতুন কী কী সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন করা হবে, তা ঠিক করতে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোয় কী কী সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সেসব জানাতে কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়গুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে কমিটির কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে কমিটি এরই মধ্যে একটি বৈঠক করেছে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুক্তি দিয়ে বলেছে, পরিকল্পনামন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রীদের প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা না দেওয়ায় জরুরি প্রয়োজনে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য যেতে হয়। এতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এর ফলে জরুরি প্রয়োজনে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব হয় না।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন এডিপির আকার ছিল ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত এক দশকে এডিপির আকার বেড়ে ২ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রকল্পের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে ১২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব আবদুল আজিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব এসেছে। আমরা সেসব প্রস্তাব পর্যালোচনা করছি।’ অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের বিনিয়োগ প্রকল্পের অনুমোদনের ক্ষমতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন মন্ত্রণালয়ের কোন প্রকল্প অনুমোদন পায়, তার সব তথ্যই পরিকল্পনা কমিশনে থাকে। সারা দেশে কোথায় কোথায় সড়ক হচ্ছে, রেললাইন হচ্ছে, উন্নয়নের সব তথ্যই সমন্বয় করে পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলো যদি প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা পায়, তখন সমন্বয় করা কঠিন হবে। দ্বৈততা দেখা দেবে।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন এডিপির আকার ছিল ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত এক দশকে এডিপির আকার বেড়ে ২ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রকল্পের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। একদিকে যেমন এডিপির আকার বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকল্পের সংখ্যাও বাড়ছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের চাহিদাও বেড়েছে। তাই একেকটি প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা এমনকি লাখ কোটি টাকাও ছাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পরিকল্পনামন্ত্রীর বিদ্যমান প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা ৫০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। মূলত, একনেক কমিটির ওপর চাপ কমাতেই পরিকল্পনামন্ত্রীর প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দিলে অপব্যবহার বাড়বে। তখন তারা প্রকল্পকে ভাগ করে সব প্রকল্প ১০০ কোটি টাকার নিচে নামিয়ে আনবে। এতে অন্য কেউ জানতে পারবে না, কোন মন্ত্রণালয় কী ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।সাবেক সচিব এম ফাওজুল কবির খান
যদিও অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদের বিনিয়োগ প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে নয় পরিকল্পনা কমিশন। তাদের অভিমত, এটি করা হলে সরকারি অর্থ অপচয় বাড়বে। বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে। উল্লেখ্য, এখন অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা কারিগরি প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদন করতে পারেন। আর জরিপ এবং সমীক্ষাসংক্রান্ত প্রকল্পে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদন করতে পারেন মন্ত্রীরা।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব এম ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দিলে অপব্যবহার বাড়বে। তখন তারা প্রকল্পকে ভাগ করে সব প্রকল্প ১০০ কোটি টাকার নিচে নামিয়ে আনবে। এতে অন্য কেউ জানতে পারবে না, কোন মন্ত্রণালয় কী ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বরং যে কাজটি জরুরি, সেটি হলো প্রকল্প প্রস্তুত করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পরিকল্পনা কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
জানা গেছে, নতুন পরিপত্রে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো নিজস্ব অর্থায়নে যেসব প্রকল্প নিজেরাই অনুমোদন করে, সেগুলোকে একটা কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে আনার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশেষ প্রকল্প ছাড়া সব প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল অনধিক তিন বছরের মধ্য রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন বছর থেকে সংশোধিত পরিপত্রটি কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।