বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিময় হারকে বাজারের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন। তবে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছুটা নিয়ন্ত্রিতভাবে বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধান কিছু মুদ্রার সমন্বয়ে একটা কারেন্সি বাস্কেট পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের প্রথম দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অধিবেশনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে করোনা-পরবর্তী সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে এক্সচেঞ্জ রেট বা মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আর্থিক খাতে সুশাসন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বাজারেও তেমন শৃঙ্খলা নেই। এখন রপ্তানিকারকেরা আমদানিকারকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে অনানুষ্ঠানিকভাবে মুদ্রার দর ঠিক করছে। ব্যাংকগুলোও অনানুষ্ঠানিক দরে লেনদেন করছে বলে শোনা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে জরিমানার কথা জানিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি সামনে রেখে বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
মনজুর হোসেন বলেন, ‘অনেক দেশ বিভিন্ন সময়ে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকেরা কী করবেন, জানি না। তবে আমাদের অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলো মেনে চলা উচিত।’
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বলেন, বিনিময় হারের সঙ্গে সুদহার ও মূল্যস্ফীতির মতো অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সম্পর্ক রয়েছে। একটি আরেকটিকে প্রভাবিত করে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে অন্যান্য সূচকও বাজারের ওপর ভিত্তি করে বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো সেটা করা হবে কি না। এ জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা রয়েছে কি না, তা-ও দেখা প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় হারের অনানুষ্ঠানিক দর মানা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সূচকে। এ নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ দেখা যায় না বলে মন্তব্য করেন মনজুর হোসেন।
মনজুর হোসেন আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছিল। করোনার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে প্রবাসী আয় বেড়ে যায়। রপ্তানিও মোটামুটি অব্যাহত থাকে। এর পাশাপাশি আমদানি কমে যায়। এ কারণে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ওই সময় বিনিময় হার কিছুটা কমানো গেলে বাজার থেকে ডলার ঋণ করে রিজার্ভে তা কৃত্রিমভাবে যোগ করার প্রয়োজন ছিল না। রিজার্ভ বেড়ে যাওয়ায় তা ব্যবহারের জন্য একধরনের চাপ তৈরি হয়। অর্থাৎ ওই সময় নীতিনির্ধারকদের দূরদৃষ্টির অভাব ছিল। বিনিময় হার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এই দুর্বলতা বা ত্রুটিযুক্ত নীতি যা-ই বলি না কেন, এর কারণে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এর ফল বর্তমানে দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচনের পরে তড়িৎ পদক্ষেপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে বেশ উত্থান-পতন দেখা গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় কোনো সংস্কারে আমরা হয়তো যেতে পারব না। তবে নির্বাচনের পরে যতটা সম্ভব বাজারভিত্তিক সংস্কার পদক্ষেপের দিকে যেতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।’
আরও ১৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন
বিআইডিএস গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, দেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতিতে অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের ভূমিকা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের আলোকেই ভোক্তা পণ্যের দাম নির্ধারণ করছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রকৃত বিনিময় হার ধরে আনুষ্ঠানিক বিনিময় হারকে আরও ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত অবমূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এর পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। মনজুর হোসেন বলেন, ‘দেশে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরে তা মূল্যস্ফীতি উসকে দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে এখন জ্বালানির দাম কমলেও দেশে আমরা দাম কমাচ্ছি না।’
এ ছাড়া বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আনতে ডলার, ইউরো, ইয়েনের সমন্বয়ে তিন মুদ্রার একটি বাস্কেট পদ্ধতিতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মনজুর হোসেন। তিনি একে ‘থ্রি কারেন্সি বাস্কেট’ পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।