গত বছর দেশে মোট ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ লাখ কেজি বেশি। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় নিলামে কমেছে চায়ের দাম।
সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে বাংলাদেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত বছর দেশের ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা–চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরুর পর ১৮৪ বছরের ইতিহাসে গত বছর প্রথমবারের মতো চা উৎপাদন ১০ কোটি কেজি ছাড়িয়েছে।
এর আগে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছিল ২০২১ সালে। সে বছর দেশের সব বাগান মিলিয়ে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল, এখন সেটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড ২০১৯ সালে। ওই বছর চা উৎপাদিত হয়েছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চায়ের ইতিহাসে উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে গত বছর। চা বোর্ড, বাগানমালিক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষি—সবার দলগত সাফল্যে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, দেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৩০ লাখ কেজি। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বাড়তি চা রপ্তানিতে নজর দিতে হবে। গত বছর ১০ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি বাড়াতে চায়ের গুণগতমান আরও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে রপ্তানি বাজারও সম্প্রসারিত হবে।
চা বোর্ডের পক্ষ থেকে গত বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ লাখ কেজি বেশি চা উৎপাদিত হয়েছে। তাতে আগের বছরের তুলনায় চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।
এমন সময়ে চায়ের উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে যখন দেশে চায়ের চাহিদা কমছে। বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় নিলামে চায়ের বিক্রি কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে নিলামে চায়ের গড় দামও। গত এপ্রিল থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামে চায়ের ৩৭টি নিলামে ৭ কোটি ৩৯ লাখ কেজি চা বিক্রি হয়েছে, যা আগের মৌসুমের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ কম। আবার নিলামে কেজিপ্রতি চায়ের গড় দর গত মৌসুমের চেয়ে ১৭ টাকা কমে নেমেছে ১৮৪ টাকা ৫২ পয়সায়।
দেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৩০ লাখ কেজি। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বাড়তি চা রপ্তানিতে নজর দিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে চায়ের গুণগতমান আরও বাড়ানোর প্রয়োজন।মো. আশরাফুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চা বোর্ড
চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরান তানভিরুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনুকূল আবহাওয়া ও নিয়মিত সংস্কার কার্যক্রমের কারণে চা উৎপাদনে গত বছর রেকর্ড হয়েছে। তবে শুধু উৎপাদন দেখলে হবে না। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় নিলামে চায়ের সরবরাহও বেড়েছে। তাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পাওয়া যাচ্ছে না। নিলামে ভালো দাম না পেলে বহু চা–বাগান টিকে থাকতে পারবে না।
কামরান তানভিরুর রহমান আরও বলেন, চাহিদার উদ্বৃত্ত চা রপ্তানি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। চা রপ্তানি করতে হলে মান বাড়াতে হবে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের চায়ের মান ভালো হলেও উত্তরাঞ্চলে ক্ষুদ্র চাষ থেকে যে চা আসছে, সেগুলো খুব নিম্নমানের। এই নিম্নমানের চা নিলাম বাজারে দামের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
চা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, চা বাগান ও ক্ষুদ্র চাষিদের উৎপাদিত চা নিলামে বিক্রি করতে হয়। বাগানমালিকেরা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ চা কর দিয়ে নিজেরা প্যাকেটজাত বা রপ্তানির জন্য সংগ্রহ করতে পারেন। নিলামে চায়ের গুণগতমান ও সরবরাহের ওপর দর হাঁকেন ক্রেতারা।
বাংলাদেশে প্রথম চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামের পাইওনিয়ার বাগানে। বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্লাবের আশপাশের এলাকায় ছিল ওই বাগানে অবস্থান। সেই বাগানে প্রথম চা উৎপাদিত হয় ১৮৪৩ সালে। ১৮৭৫ সালে চট্টগ্রাম ক্লাব প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত এই বাগানে চা উৎপাদন হয়েছিল বলে ১৮৭৩ সালের চা–বিষয়ক কৃষি বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
তবে ১৮৫৪ সালে সিলেটে মালনীছড়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষের জন্য বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস, সিলেট-এ বলা হয়, সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বিশ্বে ৪৭টি দেশে চা উৎপাদিত হয়। লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অষ্টম। এক দশক আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম।