ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সারা বিশ্ব। তিনি যে বাণিজ্যনীতি বাস্তবায়ন করবেন, তার মূল খুঁটি হবে ট্যারিফ বা শুল্ক। ঢাকায় ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই নীতি বাংলাদেশের জন্য কিছু সুযোগ তৈরি করতে পারে, তবে দরকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া।
আগামী জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করবেন। তবে এর মধ্যে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে, এমন পণ্যের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাংশ শুল্ক বসবে। কোনো কোনো দেশের জন্য এই শুল্ক ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। মূলত তিনি চীনকে লক্ষ্য করে বাণিজ্যযুদ্ধের যে অস্ত্র শানাচ্ছেন, তা ইতিমধ্যে ‘ট্রাম্প ট্যারিফ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ ট্রাম্প শুরু করেছিলেন তাঁর প্রথম মেয়াদেই। ওই সময় তিনি শত শত কোটি ডলারের চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেন। তাঁর নতুন দফায় চীনা পণ্যের ওপর শুল্কের হার নিশ্চিতভাবে আরও বাড়বে। দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীন ছিল সস্তা পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা সস্তা পণ্যের খোঁজে বাকি বিশ্বের দিকে তাকাবে।
সব যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে সুবিধা দেয়। ট্রাম্পের এই বাণিজ্যযুদ্ধে যেসব দেশ সুবিধা পেয়েছে, তাদের একটি ভিয়েতনাম। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনকে নানা ফন্দিফিকির খুঁজতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখন চীন তার বিনিয়োগ বাড়ায়, যেখানে থেকে সহজে মার্কিন বাজারে ঢোকা সম্ভব হয়।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মরত কোম্পানিগুলোর সংগঠন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ট্রাম্পের নীতির কারণে তাঁর প্রথম মেয়াদে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভিয়েতনাম। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে বাজার ধরে রাখতে চীনের উৎপাদকেরা বিকল্প উপায় হিসেবে ভিয়েতনামে বিনিয়োগ বাড়ায়। চীনা বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কারখানা ভিয়েতনামে নিয়ে আসে।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসেনি। ফলে বাইডেন প্রশাসনের সময়ও ভিয়েতনাম ছিল চীনা বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। কারণ, বাণিজ্যের দিক থেকে ভিয়েতনাম মার্কিন বাজারে সুবিধা পেয়ে আসছিল। বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০২৩ সালেই ভিয়েতনামে ৪৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।
এইচএসবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় পরের বছরে ভিয়েতনামে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামে যত বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার ২০ শতাংশের উৎস ছিল চীনের বড় বড় সব কোম্পানি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভিয়েতনাম আশা করছে, সম্ভাব্য উচ্চ শুল্ক এড়াতে চীনা কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদনব্যবস্থা বিদেশে নিয়ে যাবে এবং এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম হবে তাদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য। নির্বাচনের পরের দিন, অর্থাৎ ৬ নভেম্বর ভিয়েতনামের বড় সব শিল্প প্লট বিক্রিকারী কোম্পানির শেয়ারের দাম এক দিনে সবচেয়ে বেশি বাড়ে।
প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুপরিচিত ‘চায়না প্লাস ১’ নীতির কারণে চীনের উৎপাদনব্যবস্থার একটি অংশ চলে গিয়েছিল ভিয়েতনাম, ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। প্রতিবেশী দেশ হওয়া ও সস্তা শ্রমের কারণে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ভিয়েতনাম। চীনের কোম্পানিগুলো এখন সোলার, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক গাড়ি ও খনিজ সম্পদের মতো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করছে।
চীনের বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এখন দেশের বাইরে একটি উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী। হ্যানয়ে আমেরিকান চেম্বারের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডাম সিটকফ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভিয়েতনামের দেওয়া সুবিধার ব্যাপারে মার্কিন কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা খুবই আগ্রহী। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন তা অব্যাহত থাকবে।
সৈয়দ এরশাদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ করার নানা রকম চেষ্টা সত্ত্বেও কেন চীনের বিনিয়োগ তেমনভাবে পায়নি, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এখানে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে হরেক রকম সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানের দিকে সবার আগে নজর দিতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী আছে, তাদের যত্ন নেওয়া।
অর্থনৈতিক কূটনীতি করার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে অ্যামচেমের সভাপতি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্র্যান্ডিং দরকার। কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে বিদেশে বেসরকারি খাতের যোগ্য লোক পাঠানো উচিত। আগে আপনাকে নিজের দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে, আপনি ট্রাম্পের নীতি থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারবেন না। ’
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি চীনের ব্যাপারে তাঁর শুল্কনীতি নিয়ে অগ্রসর হন, তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম এই দুই অর্থনীতির বাণিজ্যযুদ্ধ সব দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। বেশি ওলটপালট ঘটবে সম্ভবত এশিয়ার দেশগুলোতে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চীনের ওপর অত্যন্ত উঁচু হারের শুল্কের কারণে আরেক দফা কারখানা স্থানান্তর ঘটবে।
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, চীন অথবা যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো রয়েছে, সেগুলো দূর করতে বাংলাদেশ খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। সে কারণেই এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কার দরকার।
মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, ব্যবসা করার খরচ, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, এক দরজায় সব সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা, কারখানার জন্য জমি পাওয়া, বিভিন্ন পরিষেবা, বন্দরের সুবিধা, কাস্টমস, আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা—এর সবকিছুই বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সবকিছুতেই বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতিও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন র্যাপিড চেয়ারম্যান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি চাপে থাকে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পান না। বাংলাদেশে রিজার্ভ পরিস্থিতির যদি উন্নতি না ঘটে, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে।