হজের খরচ চলতি বছর এতটা বেড়েছে কেন

স্ত্রীকে নিয়ে পবিত্র হজে যেতে ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা মো. কফিল উদ্দিন। সে সময় বেসরকারিভাবে হজে যাওয়ার ‘সাধারণ’ প্যাকেজের মূল্য ছিল জনপ্রতি ৩ লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা। তবে করোনা মহামারির কারণে সে বছর শেষ মুহূর্তে যেতে পারেননি তাঁরা।

চলতি বছর হজে যেতে আবার পরিকল্পনা করছেন কফিল উদ্দিন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, এ বছর বেসরকারিভাবে জনপ্রতি হজ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে কমপক্ষে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৭ টাকা। অর্থাৎ এটাই সর্বনিম্ন প্যাকেজ মূল্য, তবে এটা তিন বছর আগের খরচের প্রায় দ্বিগুণ।

সরকারি আয়োজনে হজের প্যাকেজ মূল্য চলতি বছর আরও ১০ হাজার টাকা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় হজ পালনের খরচ ২৯ শতাংশ বা প্রায় দেড় লাখ টাকা বেড়েছে।

রাজশাহীর কফিল উদ্দিন এখন ভাবছেন বাড়তি টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়। তাঁর পরিকল্পনা নিজের কিছু জমি বিক্রি করা। তবে তাঁর মতো জমি বিক্রি করার সংগতি হয়তো সবার নেই। ফলে মূল্যবৃদ্ধির ফলে হজযাত্রা নিয়ে দোলাচলে পড়েছেন হজ করতে ইচ্ছুক অনেকে।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রতিবছর যত মানুষ হজ পালন করতে নিবন্ধন করেন, তাঁদের সিংহভাগই হজে যান বেসরকারি বিভিন্ন হজ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

গত মাসে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় হজ চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন পবিত্র হজ পালনে যেতে পারবেন। তাঁদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ ব্যক্তি হজে যেতে পারবেন।

খরচ বাড়ার কারণ কী

হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন জানান, এ বছর বিমানভাড়া, মক্কা-মদিনার বাড়িভাড়া ও পরিষেবা খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে ডলার ও সৌদি মুদ্রা রিয়েলের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে হজ পালনের খরচ বেড়েছে।

শাহাদাত হোসাইন আরও বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে হজ প্যাকেজের ব্যয় বৃদ্ধি হজ যাত্রীদের জন্য অবশ্যই চাপের। তবে এ আর্থিক চাপ যতটা সম্ভব কম রাখা যায়, সেই চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করে হাব। তবে এ ক্ষেত্রে হাব সরকারি প্যাকেজ মূল্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের প্যাকেজ সাজায়।

সংগঠনটির তথ্য অনুসারে, গত বছর কোরবানি ছাড়া বেসরকারি ‘সাধারণ’ হজ প্যাকেজের সর্বনিম্ন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। চলতি বছর সেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৬১৮ টাকা।

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সরকারিভাবে গত বছর হজযাত্রার দুটি প্যাকেজ ছিল। এর একটিতে ব্যয় ছিল (কোরবানি ছাড়া) ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা ও অপরটির ব্যয় ছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৪৯ টাকা।

চলতি বছর হজের জন্য সরকারিভাবে একটি প্যাকেজই রাখা হয়েছে এবং এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় সরকারিভাবে হজযাত্রার খরচ বেড়েছে ন্যূনতম ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৭৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২০ হাজার ৮৬৫ টাকা পর্যন্ত।

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাজিদের স্বার্থে হজ প্যাকেজের খরচ যাতে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সে জন্য আমরা সব পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছি। সেই ভিত্তিতেই বর্তমান প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে।’

কোন খাতে খরচ বাড়ল

গত বছরের হজ প্যাকেজের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ও আসার বিমানভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তা ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য জানাচ্ছে, ২০১০ সালে সরকারি হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া ছিল ৯৬ হাজার ৪২৫ টাকা। সেই হিসাবে দেড় দশকের কম সময়ে হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

গত বছর হজযাত্রী পরিবহনে ১৬৫টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৮৭টি, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস ৬৪টি ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস ১৪টি ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পরিবহন করে।

সাধারণভাবে ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা পথে একটি রাউন্ড ট্রিপে বিমানের টিকিটের মূল্য ধরা হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। সেই তুলনায় হজ প্যাকেজের বিমানভাড়াকে অনেক বেশি বলে মনে করেন হজযাত্রী ও হজ এজেন্সি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

হজ এজেন্সি এয়ার টাচ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াকুব শরাফতী বলেন, ‘সৌদি আরবের অংশের খরচ তো আমরা কমাতে পারব না। তবে বিমানভাড়া তুলনামূলক অনেক বেশি বেড়েছে। হাজিদেরকে কিছুটা সুবিধা দেওয়ার জন্য এই খরচ কমানো প্রয়োজন।’

এদিকে বিমানভাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের জন্য বাড়িভাড়া বাবদ ব্যয়। গত বছর হজ প্যাকেজে বাড়িভাড়া (ভ্যাটসহ) ছিল ৬ হাজার ৫০৪ রিয়েল বা ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২০১ রিয়েল বা ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। গত বছর বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি রিয়েলের দাম ২৪ দশমিক ৩ টাকা হিসাব করা হয়েছিল। চলতি বছর তা হিসাব করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা।

হজের সময় পাঁচ দিন ধরে মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় হজযাত্রীদের বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে—তাঁবুর ব্যবস্থা করা, তাঁবুতে ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ, কম্বল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ ইত্যাদি।

মোয়াল্লেম সেবা হিসেবে পরিচিত এসব পরিষেবার জন্য খরচ গত বছর প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৫২০ রিয়েল বা ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা (প্রতি রিয়েল ২৪ দশমিক ৩ টাকা ধরে) নির্ধারণ করা হয়েছিল।

পরে তা বেড়ে হয় ৫ হাজার ৬৫৬ রিয়েল বা ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এ বছর এই খাতের খরচ মাত্র ২ রিয়েল বেড়েছে। তবে মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ায় (প্রতি রিয়েল ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা ধরে) তা ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা হয়েছে।

এ ছাড়া চলতি বছর হজ যাত্রীদের খাবার খরচ, জমজমের পানি, ভিসা ফি ও হজ গাইড বাবদ ব্যয় বেড়েছে।

ব্যয় কমেছে যেসব খাতে

গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের হজ প্যাকেজে মোটাদাগে ব্যয় কমেছে দুই খাতে। সৌদি আরবে অবস্থানকালে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতে পরিবহন ব্যয় বাবদ গত বছর নেওয়া হয়েছিল ৪২ হাজার ৬৩৫ টাকা করে। এবার তা কমে হয়েছে ৩৫ হাজার ১৬২ টাকা।

এ ছাড়া প্রতিজন হাজির স্বাস্থ্যবিমা বাবদ সৌদি সরকারকে আগে দিতে হতো ২ হাজার ৬৭৩ টাকা। এ বছর তা কমে হয়েছে ৯৪৭ টাকা। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, হজের প্যাকেজ ঘোষণার পর কোনো কারণে খরচ বৃদ্ধি পেলে, তা হজযাত্রীকেই পরিশোধ করতে হবে। আর অব্যয়িত কোনো অর্থ থাকলে তা ফেরত দেওয়া হবে।

হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘হজের মৌসুম শুরু হতে হতে টাকার বিপরীতে রিয়েলের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। তখন আমাদের ব্যয় আরও বাড়বে। তবে এ বছর কোনোভাবেই যাতে হজ প্যাকেজের খরচ না বাড়াতে হয়, আমরা সেই চেষ্টা করব।’