নভেম্বরে পণ্য রপ্তানি কমেছে ৬ শতাংশ, কমেছে টানা দুই মাস

দীর্ঘদিন ধরে চলা ডলার–সংকট কাটছে না। এমন এক পরিস্থিতিতে ডলার আয়ের অন্যতম উৎস রপ্তানি আয়েও খুব বেশি সুখবর নেই। তবে ডলারের আরেক উৎস প্রবাসী আয়ে গত মাসে কিছুটা সুখবর মিলেছে। কিন্তু ভালো করছে না রপ্তানি খাত। শ্লথ হয়ে পড়েছে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পণ্য রপ্তানি বাড়লেও অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় কমে যায় প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। সর্বশেষ গত মাসে, অর্থাৎ নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ৬ শতাংশ। এই মাসে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪৭৮ কোটি ডলারের, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ শতাংশ কম। আর এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কম।

সব মিলিয়ে গত জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২ হাজার ২২৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের চার মাস শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল সোমবার পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তৈরি পোশাক ছাড়া অধিকাংশ পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। তখন প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্য অনুসারে, নভেম্বর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পণ্য রপ্তানি ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ পিছিয়ে আছে।

তুলনামূলকভাবে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকই বিশ্ববাজারে ভালো করেছে। ইপিবির পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ১ হাজার ৮৮৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। আলোচ্য সময়ে নিট পোশাকের রপ্তানি ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, শুধু নভেম্বরে ৪০৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দিন ধরেই তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম। পোশাকের দামও কম। আবার মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণেও অক্টোবর ও নভেম্বরের তিন সপ্তাহ বেশ কিছু কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে করে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে।

অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘পোশাকের ক্রয়াদেশ এখনো খারাপের দিকেই আছে। যদিও ক্রয়াদেশ দিতে বিদেশি ক্রেতাদের অনুসন্ধান বেড়েছে। এগুলো চূড়ান্ত হতে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে সামগ্রিকভাবে বাজার খারাপ। ক্রেতারা খুব একটা উচ্চাশা প্রকাশ করছেন না।’

অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বাজারে চাহিদার ঘাটতি আছে। আগামী মাসগুলোতে তা অব্যাহত থাকতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক

তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি চামড়া ও চামড়া পণ্য খাতে। এ খাতে মোট ৪২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ২০ শতাংশ কম। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪২ কোটি ডলারের প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৮৬ শতাংশ কম।

অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে ১১ শতাংশের মতো। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৩৬ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ ছাড়া হোম টেক্সটাইলে রপ্তানি কমে গেছে ৪২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২০ কোটি ডলারের প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি কমেছে ৮ শতাংশ।

মোটাদাগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস তিনটি—রপ্তানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, যা আন্তর্জাতিক লেনদেনে দেশের সক্ষমতা বাড়ায়।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এতে দেশের ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলার–সংকট তৈরি হয়। দ্রুত বাড়তে থাকে ডলারের দাম। বর্তমানে আমদানিতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে প্রতিটি ডলার বিক্রি করছে ১২৫-১৩০ টাকায়।

এদিকে গত বছর ডলার–সংকট প্রকট হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতে টান পড়ে। এরই মধ্যে টানা দুই মাস রপ্তানি কমে যাওয়ার খবর এল।

অন্যদিকে পণ্য রপ্তানির বড় দুই বাজার নিয়েও নতুন দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। তার কারণ, গত মাসে বিশ্বজুড়ে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, যাঁরা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাঁদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

আবার পণ্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি কর্মসূচির ওপর মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের ব্যত্যয় হলে সুবিধাভোগী দেশগুলো তাদের জিএসপি সুবিধা হারাতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বাজারে চাহিদার ঘাটতি আছে। আগামী মাসগুলোতে তা অব্যাহত থাকতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার উদ্যোগ দরকার। অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়াতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যদিকে শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সতর্কবার্তা আছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি খাতে যেন শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।