সম্প্রতি ৪৮৬ জন উপকারভোগীর ওপর এ জরিপ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি। তাতে বয়স্ক ও বিধবা ভাতার কার্ডের নানা অসংগতি উঠে আসে।
বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে একেকজন সুবিধাভোগীকে গড়ে ২ হাজার ৬৫৩ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের এ ঘুষ দেন ভাতাপ্রত্যাশীরা। কারণ, ঘুষ না দিলে ভাতা পাওয়ার তালিকায় তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয় না। ঘুষ দিতে না পারায় ভাতা কার্ড পাননি, এমন ঘটনাও ঘটেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ঘাটতি নিরূপণ এবং এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির বিষয়ে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এ জরিপ করা হয়। গতকাল রোববার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইনে আয়োজিত এক সংলাপে জরিপে প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরে সিপিডি। ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় এ জরিপ করা হয়। জরিপে ঘুষের বিষয়টি ছাড়াও বয়স্ক ভাতার কার্ড প্রাপ্তির নানা ভোগান্তি ও অসংগতির চিত্র তুলে ধরা হয়।
সিপিডি জানিয়েছে, জরিপে দেশের ২৯টি উপজেলার ৪৮৬ জনের বয়স্ক ও বিধবা ভাতার সুবিধাভোগীর মতামত নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ১০৮ জন বয়স্ক, ২০০ জন বিধবা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ১৭৮ জন অভিভাবক। জরিপের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এবং যেখানে কম সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষাবেষ্টনী রয়েছে, সেসব স্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জরিপে উঠে এসেছে, স্থানীয় পর্যায়ে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কার্ড করতে গিয়ে একজন উপকারভোগীকে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। আর এসব ঘুষ নিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও সরকারের কর্মকর্তারা।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সদস্য আরমা দত্ত এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক মো. মোক্তার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বজলুল হক খোন্দকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ প্রমুখ।
জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং গবেষণা সহযোগী এ এস এম শামীম আলম শিবলী। জরিপের ফলাফল তুলে ধরে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত অনেকে ভাতা পাচ্ছেন না। আবার ভাতার দরকার নেই, এমন অনেকে নিয়মিত ভাতা নিচ্ছেন। এ দুই ধরনের চিত্রই পাওয়া গেছে জরিপে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ৩৩ লাখ বয়স্ক ও ২৫ লাখ বিধবা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভাতা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ বয়স্ক ও ৩৩ শতাংশ বিধবা ভাতা পাওয়ার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। এতে করে তাঁদের পেছনে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এ টাকা দিয়ে প্রায় ১৫ লাখ বয়স্ক ও বিধবাকে ভাতার আওতায় আনা সম্ভব।
বর্তমানে অধিকাংশ সরকারি ভাতা মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু জরিপে উঠে এসেছে, বয়স্ক ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৭ শতাংশের কোনো এমএফএস হিসাব নেই, বিধবাদের ক্ষেত্রে তা ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া ৫-৩০ শতাংশ প্রাথমিকের শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে উপবৃত্তি পান না বলেও জরিপে উঠে এসেছে।
সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে, বয়স্ক ভাতার উপকারভোগীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশের নির্ধারিত পরিমাণের বেশি জমি রয়েছে। আবার উপকারভোগী বিধবাদের ৫ শতাংশ সরকারের অন্য ভাতা পান। অন্যদিকে ভাতা পান না এমন ৫৬ শতাংশ বয়স্কের মাসিক আয় ১ হাজার টাকার নিচে। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে কিংবা ভূমিহীন হওয়া সত্ত্বেও অনেকে ভাতা পাচ্ছেন না। উপকারভোগী বাছাইপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে মনে করে সিপিডি। উপকারভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কথা স্বীকারও করেছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক মো. মোক্তার হোসেনও।
জরিপে উঠে এসেছে, ভাতাগ্রহীতাদের ১৩ থেকে ১৮ শতাংশ ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ। ফলে ভাতার অর্থের বেশির ভাগই তাঁরা চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করেন। এ কারণে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাবও উঠে এসেছে। বর্তমানে বয়স্ক ও বিধবারা মাসে ৫০০ টাকা ভাতা পান। এ ভাতা আগামী অর্থবছর থেকে বাড়ানোর কথা উঠে আসে জরিপে।
অনুষ্ঠানে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ভাতা প্রদানের দায়িত্বে যেসব মন্ত্রণালয় রয়েছে, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের দুর্বলতা রয়েছে। এ জন্য দেখা যায়, অনেকে একাধিক ভাতা পাচ্ছেন, আবার অনেকে কোনো ভাতা পান না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্রটা এখন অতিক্ষুদ্র ধনিক গোষ্ঠী, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হাতে বন্দী হয়ে গেছে। এ কারণে বৈষম্য অনেক বেড়েছে। দারিদ্র্য কমেছে বলে আমরা উৎফুল্ল হতে পারি। কিন্তু বর্তমানে বৈষম্য এত বেশি যে সেখানে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’ এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি আরও বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।