বুধবার দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্দিকবাজারের বিধ্বস্ত কুইন স্যানিটারি মার্কেট এলাকায় নতুন করে শুরু হয় উদ্ধার তৎপরতা। বেলা গড়াতে থাকলেও তখনো নিখোঁজ অনেকেই। এর মধ্যে সবার মুখে মুখে একটি নাম—মমিনুদ্দিন সুমন। মমিনুদ্দিন কোথায়, কোনো খোঁজ পাওয়া গেল কি না, এমন প্রশ্ন অনেকের মুখে। বিস্ফোরণের ঘটনায় নিখোঁজ হন আনিকা এজেন্সির মালিক এই মমিনুদ্দিন। তখনো অনেকের ধারণা ছিল, ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন এই স্যানিটারি ব্যবসায়ী।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঠিক সেই ভবনের নিচ থেকেই বের করে আনেন মমিনুদ্দিনকে, তবে তখন আর তিনি জীবিত নেই। কুইন স্যানিটারি মার্কেটের নিচতলার একটিসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সুমন গড়ে তুলেছিলেন আটটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন শতাধিক কর্মী। মমিনুদ্দিনের মৃত্যুতে তাঁর পরিবারের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলেন।
মঙ্গলবার বিকেলে মার্কেটটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রথম আলোকে জানান, বংশালের বাসিন্দা মমিনুদ্দিন স্যানিটারি পণ্যের একজন বড় ব্যবসায়ী। বিধ্বস্ত মার্কেটের আনিকা এজেন্সি ছাড়াও পাশের গলিতে নিউ আনিকা স্যানিটারিসহ সিদ্দিকবাজারে মোট চারটি স্যানিটারি পণ্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া আরও দুটি বিক্রয়কেন্দ্র আছে এলিফ্যান্ট রোডে। মমিনুদ্দিনের এসব স্যানিটারি পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রে অর্ধশতাধিক লোক কাজ করেন।
বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের পাশাপাশি ছোট একটি কারখানাও গড়ে তোলেন তিনি। সেই কারখানায় ৩৫ জনের মতো কর্মী রয়েছেন। এর বাইরে বংশালে মোটরসাইকেলের বিক্রয়কেন্দ্রে কাজ করতেন আরও ১৫ জন। সব মিলিয়ে সুমনের আট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল শতাধিক পরিবার।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ২০০০ সালের দিকে মমিনুদ্দিন সিদ্দিকবাজার এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। বড় ব্যবসায়ী মমিনুদ্দিন কর্মচারীদের আগলে রাখতেন। তাঁর ঠিক কত টাকার ব্যবসা ছিল, সেটা নিশ্চিত করে কেউ জানেন না। তবে তাঁদের আন্দাজ, এটা কয়েক কোটি টাকার হবে।
সুমনের সিদ্দিকবাজারের এক শোরুমে কর্মরত একজন কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অন্য একটা দোকানে ছিলাম, তাই বেঁচে গেছি। কিন্তু আমাদের মালিক চলে গেলেন। তাতে ওনার সন্তানদের সঙ্গে আমরাও অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম।’
কুইন স্যানিটারি মার্কেটের পাশের গলির নিউ আনিকা স্যানিটারির সামনে আরও বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা হয় গতকাল। এ সময় তাঁরা তাঁদের অসহায়ত্বের কথা জানান। মালিকের এভাবে চলে যাওয়ায় অনেকে কাজ হারানোর শঙ্কায় আছেন।
মমিনুদ্দিনের বন্ধু বাংলাদেশ পাইপ অ্যান্ড টিউবওয়েল মার্চেন্ডাইজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুহাম্মদ রবিউল হক ওরফে বাদশা মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘যেভাবে সে চলে গেল, এটা একেবারে ভাবা যায় না। তার পরিবারের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। কর্মীরাও অভিভাবকহীন হলো। আপাতত এর বেশি কিছু বলার নেই। বন্ধু সুমনের জন্য সবাই দোয়া করবেন।’
রবিউল হকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাদশা ট্রেডিং। এটির অবস্থান মমিনুদ্দিনের আনিকা এজেন্সি লাগোয়া উত্তর পাশে। আনিকা এজেন্সির মতো এই প্রতিষ্ঠানও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।
বিধ্বস্ত সাততলা ভবনের উত্তর পাশের ফাতেমা মার্কেটের ব্যবসায়ী এ হাই স্যানিটারির মালিক আবদুল আজিজ ওরফে সুমন নিজেকে মমিনুদ্দিনের বাল্যবন্ধু পরিচয় দিলেন। তিনি জানালেন, ‘বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট আগেও সুমন (মমিনুদ্দিন) আমার দোকানে বসা ছিল। তার দোকানে একজন বড় ক্রেতা এলে সে চলে যায়। এরপর ঘটনাটি ঘটে। সে আমার দোকানে থাকলে, হয়তো তার এই পরিণতি হতো না।’
পরের পরিস্থিতি আবদুল আজিজ বর্ণনা করেন এভাবে, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা নাশকতার কোনো ঘটনা। এ জন্য আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার দোকানের কর্মচারীদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দোকান বন্ধ করে দিই। এর পরের ঘটনা দেখে তো আমরা হতবাক। বন্ধু সুমন চলেই গেল। অথচ বড় ব্যবসায়ী, কত স্বপ্ন ছিল। প্রতিবছর ব্যবসা বাড়াচ্ছিল। দুজনের নামের শেষে সুমন থাকায় অনেকে ভেবেছে, হয়তো আমিই মারা গেছি। অনেকে আমাকে ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে।’
মালিক মমিনুদ্দিন সুমনের সঙ্গে দোকানের কর্মচারী রবিন হোসেনের মরদেহও বুধবার বিকেলে উদ্ধার করা হয়েছে। দোকানের আরেক কর্মচারী সম্রাটের লাশ মঙ্গলবার রাতেই পাওয়া গিয়েছিল। সুমন ও রবিনের মরদেহ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২০।
মমিনুদ্দিন ছিলেন তিন সন্তানের বাবা। লাশ উদ্ধারের সময় পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কর্মচারীরা বললেন, এ দুর্যোগে তাঁরা তাঁদের মালিকের পরিবারের পাশে আছেন। একই সঙ্গে তাঁদের রুটিরুজি নিয়েও চিন্তায় আছেন।