সরকারি পদক্ষেপ, বাজারে অভিযান ও মন্ত্রীদের হুঁশিয়ারির প্রভাব বাজারে খুব একটা পড়ছে না। নিত্যপণ্যের দাম তেমন একটা কমেনি; বরং কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় দুটি পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কমেছে শুধু সয়াবিন তেলের দাম। চাল ও পাম তেলের বাজারে কোনো হেরফের নেই। বেড়েছে চিনি, মসুর ডাল, অ্যাংকর ডাল, খেসারির ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুরের দাম।
যে তোড়জোড় দেখা গিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল এবার দাম কমবে। কিন্তু বাজারে গিয়ে তা দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন তো শুনছি বিদ্যুতের দাম বাড়বে। সেটা হলে সংসারের ব্যয় বাড়বে। আবার উৎপাদন খরচ বাড়ার কথা বলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াবেন।দোকানের ব্যবস্থাপক শারাফত হোসেন
দেশে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। পাইকারি বাজারে রোজার পণ্যের কেনাবেচা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। সেখান থেকে কম দামে কিনতে পারলে খুচরায় দাম কমানোর সুযোগ থাকে।
এদিকে রোজা শুরুর আগে পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ বেড়েছে। যদিও গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, কোনো কোনো পণ্যের আমদানি এখনো কম।
নিত্যপণ্য আমদানিকারক চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার এখন পর্যন্ত রোজার পণ্যের চাহিদা কম দেখা যাচ্ছে। আমদানিও কিছুটা কম। তবে রোজার প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আরও পণ্য আসবে। তাতে সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
আওয়ামী লীগ সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছে। এবার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকারে রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলছেন। ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চাল, সয়াবিন ও পাম তেল, চিনি এবং খেজুর আমদানিতে বিভিন্ন হারে শুল্ক-কর কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি বিশ্লেষণ বলছে, শুল্ক-কর কমানোর কারণে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি ব্যয় লিটারে ৫ টাকা, পাম তেলে প্রায় সাড়ে ৪ টাকা, চিনিতে কেজিপ্রতি ৫৫ পয়সা এবং খেজুরে মানভেদে ১৩ থেকে ৩৩ টাকা কমার কথা।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩ থেকে ৫ টাকা কমেছে। পাম তেলের দাম অপরিবর্তিত।
গত বছরের তুলনায় এবার এখন পর্যন্ত রোজার পণ্যের চাহিদা কম দেখা যাচ্ছে। আমদানিও কিছুটা কম। তবে রোজার প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আরও পণ্য আসবে। তাতে সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী
ভোজ্যতেল বিপণনকারী কোম্পানি টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আথহার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন দাম আগামী ১ মার্চ থেকে কার্যকর করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাজারে দাম কিছুটা কমেছেও।
এদিকে পাইকারি বাজারে চিনির দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বেড়েছে। খেজুরের দামও বাড়তি। যেমন মঙ্গলবার মধ্যম মানের প্রতি কেজি জাইদি খেজুর বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকায়, যা আগের চেয়ে ২০ টাকা বেশি।
শুল্ক-কর কমানোর পরও কেন দাম বাড়ল জানতে চাইলে চট্টগ্রামের মায়েদা ডেটসের মালিক মোহাম্মদ জাহেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন শুল্কছাড় দেওয়া হলেও গত নভেম্বরে খেজুর আমদানির শুল্কায়নমূল্য (শুল্ক আরোপের জন্য নির্ধারিত দর) বাড়ানো হয়। এরপর খেজুর তেমন আমদানি হয়নি। আগে কম দামে কেনা খেজুর এত দিন বিক্রি হয়েছিল। তিনি বলেন, এখন শুল্কছাড় দেওয়া হলেও শুল্কায়ন মূল্যের কারণে খরচ বেশি পড়ছে। সে কারণে খেজুরের দাম বাড়তি।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন দাম আগামী ১ মার্চ থেকে কার্যকর করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাজারে দাম কিছুটা কমেছেও।ভোজ্যতেল বিপণনকারী কোম্পানি টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আথহার
রোজায় বাজারে ডালের চাহিদা বেড়ে যায়। পাইকারি বাজারে ডালের দাম বাড়তি। যেমন গতকাল ঢাকার চকবাজারের পাইকারি ডালের দোকানে প্রতি কেজি মসুর ডাল (মোটা, মাঝারি ও সরু) বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১২২ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক মাসে তিন ধরনের মসুর ডালের দাম দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। অ্যাংকর ডাল বিক্রি হয়েছে ৭২ থেকে ৭৪ টাকা কেজি। এ ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা।
পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। যেমন খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লা মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০-১২ টাকা বেড়ে ১১০-১১২ টাকা হয়েছে। এদিকে খাতুনগঞ্জে গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই পেঁয়াজ ১১৮ টাকা কেজি।
ছোলার চাহিদা রোজায় সবচেয়ে বেশি থাকে। এক মাসের ব্যবধানে চকবাজারে ছোলার পাইকারি দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৫-৯৬ টাকা। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে মানভেদে ছোলার দাম ৮০ থেকে বেড়ে ৮৫ টাকা এবং ৮৭ থেকে বেড়ে ৯৩ টাকা কেজি হয়েছে।
বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি খরচ বেশি। তাতে ছোলা ও অন্যান্য জাতের ডালের দাম আপাতত কমার সম্ভাবনা কম। তবে নতুন করে দাম আর বাড়বে না।
পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। যেমন খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লা মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০-১২ টাকা বেড়ে ১১০-১১২ টাকা হয়েছে। এদিকে খাতুনগঞ্জে গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই পেঁয়াজ ১১৮ টাকা কেজি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারে গত এক মাসে চালের দামে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। মোটা চাল ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫০-৫৫ ও সরু চাল ৬২-৭৫ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিনের সর্বনিম্ন দর ১৫৫ টাকাই রয়েছে। তবে সর্বোচ্চ দর ১৬৫ থেকে কমে লিটার ১৫৮ টাকা হয়েছে। একই ভাবে পাম তেলের সর্বনিম্ন দর কমেনি। বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা। তবে সর্বোচ্চ দর ৫ টাকা কমে ১৩০ টাকা হয়েছে।
ছোট দানার মসুর ডালের সর্বনিম্ন দর ৫ টাকা বেড়ে ১৩৫ টাকা, অ্যাংকর ডাল ১০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা, ভালো মানের ছোলা ১০ টাকা বেড়ে ১১০ টাকা এবং মুগডালের সর্বনিম্ন দর ২০ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকা কেজি হয়েছে। রোজায় খেসারির ডাল দিয়ে পেঁয়াজু তৈরি হয়। সেই ডালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১১০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির হিসাবে, খুচরা বাজারে চিনির দাম অপরিবর্তিত আছে। এক মাসে ৪ শতাংশ বেড়েছে মধ্যম মানের খেজুরের দর। দেশি পেঁয়াজের দাম ২১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১১০-১২০ টাকা।
এনবিআরের হিসাবে দেখা যায়, ছোলার আমদানিও কিছুটা বেড়েছে। তবে মসুর ও মটর ডাল আমদানি বাড়েনি। বাড়েনি চিনি আমদানিও। বিগত তিন মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ১৫ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম।
সরকার শুল্ক-কর কমানোর প্রজ্ঞাপন জারির পর গত ২০ দিনে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে খেজুর, পরিমাণ ২০ হাজার ৫৭৬ টন। পাম তেল সরবরাহ বেড়েছে। অপরিশোধিত সয়াবিনের আমদানি কমলেও সয়াবিন তেলের কাঁচামাল বীজ আমদানি বেড়েছে।
এনবিআরের হিসাবে দেখা যায়, ছোলার আমদানিও কিছুটা বেড়েছে। তবে মসুর ও মটর ডাল আমদানি বাড়েনি। বাড়েনি চিনি আমদানিও। বিগত তিন মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ১৫ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম।
ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমদানি বেশি হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দাম কমে। কিন্তু শেষ সময়ে আমদানি বাড়লেও সার্বিকভাবে সরবরাহ আগের চেয়ে বেশি নয়। তাই প্রতিযোগিতা ততটা হচ্ছে না। এ ছাড়া সরকার চিনিতে তেমন কোনো শুল্কছাড় দেয়নি। শুল্ক-কর কমানো হলেও চাল আমদানিতে পূর্বানুমতির শর্ত রাখা হয়েছে।
রাজধানীর পান্থপথে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিক্রেতা একটি দোকানের ব্যবস্থাপক শারাফত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে তোড়জোড় দেখা গিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল এবার দাম কমবে। কিন্তু বাজারে গিয়ে তা দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন তো শুনছি বিদ্যুতের দাম বাড়বে। সেটা হলে সংসারের ব্যয় বাড়বে। আবার উৎপাদন খরচ বাড়ার কথা বলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াবেন।’