ঈদের ছুটিতে বেড়াতে যাবেন উত্তরার ইফতেখার ফেরদৌস ও তাঁর তিন বন্ধু। তাঁদের কেউ চাকরি করেন, কেউবা করেন ব্যবসা। ঈদের ছুটির সময় আরও দুই দিন ছুটি নিয়ে বন্ধুরা যাবেন ঘুরতে। তাঁদের গন্তব্য শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গলের সবুজের মাঝেই তাঁরা ঘুরে বেড়াবেন। এ জন্য তাঁরা ২৪ ও ২৫ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলের একটি ইকো রিসোর্ট বুকিং দিয়ে ফেলেছেন। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
হাসিনা নাসরিন পেশায় ব্যাংকার। ঈদের পরের সপ্তাহে আরও চার সহকর্মীসহ ভারতের সিকিম যাচ্ছেন। ঈদের ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে বাড়তি ছুটি নিয়েছেন। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ট্যুর পরিকল্পনায় খরচ কাটছাঁট করতে হয়েছে।
হাসিনা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের পরদিনই যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সামাজিকতার কারণে যাওয়া যাচ্ছে না। ওই সময়ে টিকিটও পাওয়া যায়নি। তাই খরচ ও ভিড়ভাট্টা এড়াতে ঈদের পরের সপ্তাহে যাচ্ছি। এই সময়ে সিকিমের তাপমাত্রা সহনীয় থাকে। সহকর্মীরা মিলে মজা করব।’
ঈদ সামনে রেখে পর্যটন ব্যবসায় চাঙা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ঈদের সময়ে নেওয়া ছুটি কাটাতে অনেকেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার (শ্রীমঙ্গল), রাঙামাটি, বান্দরবানের মতো দেশের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যের হোটেল ও যাতায়াতের টিকিট বুকিং দিতে শুরু করেছেন আগ্রহীরা। আর এসব হোটেলে চলছে আকর্ষণীয় ঈদ অফার।
দেশ ও বিদেশ—ঈদের ছুটিতে এই দুই ধরনের পর্যটন ব্যবসা চাঙা থাকে। তবে এবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিমান টিকিটের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা আগের তুলনায় কম।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ঈদের মৌসুমে দেশের অভ্যন্তরে কমবেশি পাঁচ লাখ পর্যটক দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাবেন। এই তালিকায় পছন্দের ওপরের দিকে আছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা ও সুন্দরবন।
টোয়াবের সাবেক সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাইরে যাওয়ার আগ্রহ কম থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে ঘোরাঘুরির চাপ আছে। ঈদের পরদিন থেকেই পর্যটকদের হোটেল বুকিং, টিকিট কেনায় বেশি চাপ। কক্সবাজারে ঈদের পরদিন থেকেই পর্যটক যাওয়া শুরু করবে। তখন সব হোটেল-মোটেল ভরপুর থাকবে।
এবার ঈদের মৌসুমে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে ঘোরাঘুরি করবেন বলে ধারণা করছেন ট্যুর অপারেটররা। তবে কোভিড মহামারির আগে ঈদের সময় পর্যটন ব্যবসা যতটা চাঙা থাকত, এখনো পর্যটন কার্যক্রম সেই অবস্থায় যায়নি বলে তাঁরা মনে করেন।
ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের সেবা দিতে প্রস্তুত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকতের হাতছানিতে লাখো পর্যটক যেকোনো ছুটিতে ছুটে যান সৈকত নগরী কক্সবাজারে। বাড়তি পাওনা হিসেবে আছে পাহাড়, লাল কাঁকড়ার বিচ, মেরিন ড্রাইভ ইত্যাদি। আর ভোজনরসিকদের জন্য আছে ‘সি ফুডের’ সমাহার।
পরিসংখ্যান বলছে, কক্সবাজারে সাড়ে পাঁচ শর বেশি হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট আছে। এসব হোটেলে ধারণক্ষমতা দুই লাখের বেশি। এখন রোজার কারণে বেশির ভাগ হোটেল বন্ধ। ঈদের ছুটির সময়ের পর্যটক আকর্ষণে বেশ কিছু হোটেলে সংস্কারকাজ চলছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের পরদিন থেকেই পর্যটকেরা আসা শুরু করবেন। পরের ১০ দিনে ১০ লাখ পর্যটক কক্সবাজার বেড়াতে আসবেন—এমন আশা করছি। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের কক্ষের ওপর ২০-৪০ শতাংশ মূল্যছাড় দেবে। এখনো পুরোদমে বুকিং শুরু হয়নি। ঈদের আগের সপ্তাহে বুকিং দেওয়া বাড়বে।
ঈদ সামনে রেখে দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর হোটেল–রিসোর্টে মূল্যছাড় চলছে। ছোটখাটো হোটেল–রিসোর্ট থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেলেও অফার চলছে। মধ্যবিত্তরা এই উৎসবের সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকেন—কখন তারকা হোটেল আর রিসোর্টগুলো থেকে বিশেষ অফার আসবে। এবার ঈদ মৌসুমে তাদের হতাশ হতে হবে না।
শ্রীমঙ্গলের পাঁচ তারকা গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টে ঈদ উপলক্ষে ২৩ হাজার টাকার একটি অফার আছে। সেখানে ডিলাক্স রুমে দুজন, দুই বাচ্চা, তিন বেলা খাবার এই প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে শ্রীমঙ্গলের দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পাতে ২২-২৫ এপ্রিলের জন্য ঈদ অফার দিয়েছে। ১৯ হাজার ৯০০ টাকায় দুজনের জন্য ডিলাক্স রুম, তিন বেলা খাবারসহ এ প্যাকেজটি সাজানো হয়েছে।
তুলনামূলক কমদামি রিসোর্টেও আছে নানা অফার। যেমন শ্রীমঙ্গলের শান্তি বাড়ি ইকো রিসোর্টে জনপ্রতি এক রাত থাকা খাওয়াসহ ১ হাজার ৯০০ টাকা পড়বে। আবার ডুপ্লেক্স কটেজে জনপ্রতি এই অফার ২ হাজার ৩৯০ টাকা। এ বিষয়ে শান্তি বাড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপক মো. লিংকন বলেন, ঈদের ছুটির সময়ের জন্য বুকিং প্রায় শেষ। এখন মাত্র তিন-চারটি রুম বুকিং বাকি আছে। সপ্তাহের মধ্যে সব রুম আগাম বুক হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সিলেট, মৌলভীবাজার (শ্রীমঙ্গল), হবিগঞ্জসহ ওই অঞ্চলের রিসোর্ট-হোটেলগুলো ঈদের ছুটিতে পর্যটন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চাঙা হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
ডলার ও টিকিটের বাড়তি দামের প্রভাবের কারণে এবার দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার আগ্রহ কম। বিদেশে ভ্রমণ–ইচ্ছুকেরা সাধারণত খোলাবাজার থেকে ডলার কেনেন। এখন এক ডলার কিনতে ১১০ টাকার বেশি খরচ করতে হয়। আবার বিমান টিকিটের দামও বেশ বেড়েছে। এসব কারণে এবার ঈদ মৌসুমে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক পর্যটকদের আগ্রহ একটু কম।
এ বিষয়ে কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনে ক্যামএয়ার ট্রাভেলস লিমিটেডের পরিচালক ইশতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার আগে ঈদের মৌসুমে আমরা পর্যটকদের কাছে যত টিকিট বিক্রি করতাম, এবার তার ৭০ শতাংশের মতো বিক্রি হবে বলে আশা করছি। মূলত ডলার ও টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই পর্যটকদের আগ্রহ কম।’
ইশতিয়াক আহমেদ জানান, কলকাতা-ঢাকা রুটে জনপ্রতি বিমান টিকিটের দাম ছিল ১৪ হাজার টাকার মধ্যে। ঈদ উপলক্ষে টিকিটের দাম ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা হয়েছে। ঢাকা-ব্যাংকক রুটে ৩৩-৩৪ হাজারে টিকিট পাওয়া যেত। ঈদের ছুটিতে তা ৫০-৬০ হাজার টাকায় ঠেকেছে। মালয়েশিয়া ভ্রমণেও একই হারে টিকিটের দাম বেড়েছে। ১৮-৩০ তারিখ পর্যন্ত অনেক এয়ারলাইনসে ইকোনমি ক্লাসে টিকিট নেই।