রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কারের শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সবচেয়ে বড় শর্ত হলো, আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এ জন্য আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে এ শর্ত দেওয়া হয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে এবং ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থও ছাড় করেছে।
আইএমএফ বলছে, পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, বাংলাদেশ তার একটি। ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে যতটা শুল্ক-কর আদায় করে থাকে, ভবিষ্যতে এর চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। হিসাব করে দেখা যাক, কী পরিমাণ বাড়তি কর আদায় করতে হবে।
২০১৫-১৬ সালের ভিত্তি বছর ধরা হলে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপির আকার ছিল ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ১৭ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। অবশ্য গত দুই বছরে জিডিপির আকার আরও বেড়েছে। মোটাদাগে বলা যায়, এনবিআর এখন যে প্রবণতায় কর আদায় করছে, সেই প্রবণতা ধরে রাখার পাশাপাশি আগামী কয়েক বছর বাড়তি ২০ হাজার কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর আদায় করতে হবে।
বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ের বছরওয়ারি লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে আইএমএফ। ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ হারে শুল্ক-কর আদায় বাড়াতে হবে। এরপর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াতে হবে।
কীভাবে কর আদায় বৃদ্ধি করা যায়, তা নিয়ে একটি কৌশল ঠিক করতে হবে বাংলাদেশকে। এ কাজে আইএমএফ কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইএমএফের ২০২৩ সালের প্রথম পর্যালোচনার আগেই এ কাজ করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার কারণ, এ দেশে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জটিল করব্যবস্থা, দুর্বল কর প্রশাসন—এসব কারণে কর আদায় কম হয়। ফলে সরকারকে বিপুল অর্থ ঋণ করতে হয়।
আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের সঙ্গে আরও কিছু সংস্কারের শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থা ইউনিট গড়ে তুলতে হবে, যা শুল্ক-কর আদায়ের ক্ষেত্রে আইনকানুন প্রতিপালন হচ্ছে কি না, তা দেখবে। ২০২৩ সালে আইএমএফের দ্বিতীয় পর্যালোচনার আগেই তা করতে হবে।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে একটি মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল চূড়ান্ত করতে হবে। এ কাজে আইএমএফ সহায়তা করবে। এ ছাড়া কর নিয়মকানুন প্রতিপালনের জন্য একটি পরিকল্পনা করতে হবে। এ দুটি ২০২৪ সালের আইএমএফের তৃতীয় পর্যালোচনার আগে করতে হবে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালজুড়ে এই দুটি কৌশল পরিকল্পনার বাস্তবায়নের শর্ত দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের জন্য আরেকটি বড় শর্ত হলো শুল্ক-করের অব্যাহতির পরিমাণ কমাতে হবে। বর্তমানে বছরে এনবিআর গড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো কর অব্যাহতি দেয়। পর্যায়ক্রমে এই কর অব্যাহতি কমিয়ে সরকারের বিভিন্ন খাতে খরচ করার সামর্থ্য বাড়ানোর কথা বলেছে আইএমএফ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ তা শেষ করতে হবে।
অবশ্য কর অব্যাহতির পরিমাণ কতটা কমাতে হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলেনি আইএমএফ। তবে কর অব্যাহতি কতটা কমানো হলো, তা আইএমএফের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্যালোচনার সময় আলোচনা করা হবে।
এ ছাড়া আরও কিছু সংস্কারের শর্ত রয়েছে। যেমন নিরীক্ষা কার্যক্রমে এনবিআরে শুল্ক, কর ও ভ্যাট—এই তিন বিভাগের মধ্যে তথ্যের আদান–প্রদানের ব্যবস্থা শক্তিশালী ক, কর প্রশাসন স্বয়ংক্রিয় করা, উৎসে কর আদায় বৃদ্ধি, আধুনিক শুল্ক আইন প্রণয়ন ইত্যাদি।