বিদেশি সহায়তা: প্রকল্প অর্থায়নে দাতাদের প্রতিশ্রুতিতে ধস

• একটি বড় দাতা সংস্থার তিনটি প্রকল্পে প্রায় ৬০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই তা চূড়ান্ত করার কথা। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তুত না থাকায় তা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।

• গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত হিসাবে, একনেকে অনুমোদনের জন্য মাত্র চারটি বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প প্রস্তুত করা আছে। এর তিনটিই বিদ্যুৎ খাতের।

অর্থনীতির এই চাপের সময়ে ডলার দরকার বাংলাদেশের। ডলার পাওয়ার অন্যতম বড় উৎস হলো উন্নয়ন প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা। কিন্তু নতুন নতুন প্রকল্পে বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে।

সাধারণত অর্থবছরের ছয় মাসেই ৩০০–৪০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মেলে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের জুলাই–ডিসেম্বর সময়ে মাত্র ১৭৬ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। সাম্প্রতিক সময়ে দাতারা এত কম প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

জানা গেছে, প্রকল্প নিয়ে দর–কষাকষিতে দীর্ঘসূত্রতায় প্রতিশ্রুতি কম মিলছে। ফলে বাংলাদেশকে অর্থ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগীরা, নাকি বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ কমছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন প্রকল্পে মাত্র ১৭৬ কোটি ডলারের অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। গত বছর একই সময়ে ৪৪০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলেছিল। এক বছরে ব্যবধানে অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি কমেছে ২৬৪ কোটি ডলার।

গত ছয় মাসে (জুলাই–ডিসেম্বর) সময়ে বিদেশি সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে এগিয়ে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), সর্বোচ্চ ৩৮ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আর ৩০ কোটি ডলারের আশ্বাস দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে বিশ্বব্যাংক।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ৬০০ কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। সেই হিসাবে, দাতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বেশ বড় পথ পাড়ি দিতে হবে।

কেন হঠাৎ বাংলাদেশকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশিদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে, তা খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে।

বৈশ্বিক সংকটের কারণে কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে কিছুটা লাগাম টেনে ধরেছে। বিশেষ করে নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সাবধান হয়েছে, যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। আবার মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নেও আগ্রহ কম। কারণ, বিদেশি সহায়তার প্রকল্প বাস্তবায়নে শর্ত বেশি থাকে।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, একটি বড় দাতা সংস্থার অবকাঠামো খাতের তিনটি প্রকল্পে প্রায় ৬০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই তা চূড়ান্ত করার কথা ছিল। কিন্তু প্রস্তুতি না থাকায় প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। ওই তিনটি প্রকল্প বোর্ডে অনুমোদনের সময়সীমা সংশোধন করে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে নিয়ে গেছে দাতা সংস্থাটি। যথাসময়ে প্রকল্প প্রস্তুত ও দর–কষাকষি করা গেলে প্রতিশ্রুতিতে আরও ৬০ কোটি ডলার যোগ হতো।

এর প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ায়। এখন বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প কম অনুমোদন হচ্ছে। কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে অবশ্য এমনিতেই প্রকল্প অনুমোদনের সংখ্যা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সাতটি একনেক সভায় মাত্র ৪৮টি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে নতুন প্রকল্প ২৯টি। নতুন প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বিদেশি সহায়তাপুষ্ট।

এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প প্রস্তুত করার সংখ্যাও কমেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তুত প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি প্রকল্প বিদেশি সহায়পুষ্ট। এর তিনটিই আবার বিদ্যুৎ খাতের। সাধারণত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ৮–১০টি এমন বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প সব সময় প্রস্তুত থাকে। এর মানে, দর–কষাকষি চূড়ান্ত না হওয়ায় বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিলছে না। তাই বিদেশি সহায়তা প্রকল্পগুলো এখন অনুমোদনে ধীরগতি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতির এই চাপের সময়ে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করার দরকার বেশি। কারণ, এতে দেশে ডলার আসবে। দ্রুত কর–কষাকষি করে প্রকল্প চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

একটি বছরে বাংলাদেশকে কত অর্থ দেওয়া হবে—তা নিয়ে বেশির ভাগ উন্নয়ন সহযোগীর পরিকল্পনা থাকে। তাই অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থ ছাড় না হলে দ্বিতীয়ার্ধেও ছাড় হবে না, বিষয়টি তেমন নয় বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তবে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে অনীহা আছে। কারণ, বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের অর্থ খরচে নানা ধরনের জবাবদিহি থাকে।

প্রতিশ্রুতি থাকলেও অর্থ ছাড় করাতে পারে না সরকার—এটি বহু বছরের সাধারণ চিত্র। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলারেরর প্রতিশ্রুতি পাইপলাইনে আছে। অর্থাৎ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দাতারা দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না সরকার।

ইআরডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চলতি অর্থবছরের ৬০০ কোটি ডলার পাওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। গত ছয় মাসে বেশ কিছু প্রকল্পে কর–কষাকষিতে বিলম্ব হলেও আগামী ছয় মাসে এসব প্রকল্প চূড়ান্ত হয়ে যাবে। তাই আশা করি, বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতির লক্ষ্য পূরণ হবে।