কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করার পর তৈরি পোশাক, অনলাইন ব্যবসা এবং চামড়া পণ্য ও জুতাশিল্পে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন মধ্য জুলাইয়ে সহিংস আকার ধারণা করলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। প্রথমে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তারপর ইন্টারনেট ও চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। পাশাপাশি কারফিউ বা সান্ধ্য আইনের কারণে চার–পাঁচ দিন শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও গতকাল রোববার আবার চরম অবনতি ঘটতে শুরু করেছে।
বিভিন্ন শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, চলমান অস্থিরতা যত দীর্ঘ হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে লোকসান তত বাড়ছে। শুধু তা–ই নয়, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। কারণ, অনিশ্চয়তা থাকলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে খুব একটা আগ্রহ দেখাবেন না।
বর্তমান পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়ী সংগঠন। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক, অনলাইন ব্যবসা এবং চামড়া পণ্য ও জুতাশিল্পে ক্ষতির পরিমাণ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যানুযায়ী, গত ২০ জুলাই থেকে চার দিন কারখানা বন্ধ থাকায় এই খাতে দিনে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তার মানে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) দাবি হচ্ছে, ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ থাকায় দেশের অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা খাতে ১৩ দিনে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া চামড়া পণ্য ও জুতা উৎপাদন এবং রপ্তানিকারক সমিতির (এলএফএমইএবি) দাবি অনুযায়ী, চামড়া পণ্য ও জুতা রপ্তানি খাতে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৩০৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ ডলারের চামড়া পণ্য, ১ কোটি ২০ লাখ ডলারের চামড়ার জুতা এবং ৮০ লাখ ডলারের চামড়াবিহীন জুতা বা নন-লেদার ফুটওয়্যার রয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস আকার ধারণ করে। পরে সংঘাত আরও বাড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করে সরকার। সে সময় ইন্টারনেট না থাকায় চার দিন বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২৩ জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে শিল্পকারখানা চালু হয়। তবে গতকাল রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদন আবার বন্ধ হয়ে যায়।
গত মাসে ইন্টারনেট, কারখানা ও বন্দর বন্ধ থাকায় তৈরি পোশাক খাতের বেশ কিছু কোম্পানিকে নিজস্ব খরচে উড়োজাহাজে করে বিদেশে পণ্য পাঠাতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে পণ্য পাঠাতে না পারায় অনেক কোম্পানিকে বাড়তি সময় দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তবে এই সুযোগ দিলেও অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আবার মূল্যছাড়ও দাবি করছে। এ ছাড়া নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা কিছুটা ধীরে চলো নীতি নিয়েছেন।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। বিদেশি ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন। আমাদের শঙ্কা, অনিশ্চয়তার কারণে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের ক্রয়াদেশ ১০-৩০ শতাংশ কমবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতির চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক হবে না। আমাদের প্রত্যাশা, দ্রুত সময়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। বর্তমান সহিংস অবস্থা সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনীতি কোনটির জন্য ভালো নয়। আমাদের শিল্পকারখানারও এই ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা নেই।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান অস্থিরতায় জুতা রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনিশ্চয়তা থাকলে বিদেশি ক্রেতারা আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের ক্রয়াদেশ দেওয়ার মতো ঝুঁকিতে যাবেন না। ফলে দেশ, জাতি ও অর্থনীতির স্বার্থে দ্রুত সময়ের মধ্যে বর্তমান সমস্যার সমাধান করা দরকার। যত দিন যাবে ব্যবসায়ে লোকসান বাড়বে। তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যও ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।