দেশে শতভাগ ক্যাশলেস বা কাগুজে নোটবিহীন লেনদেন নিশ্চিত করতে হলে কর্মপরিকল্পনার বিকল্প নেই বলে মনে করেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, নগদ অর্থ ব্যবহার ছাড়া লেনদেন করতে যে ধরনের প্রযুক্তিগত অবকাঠামো দরকার, তা দেশে এখনো সম্পূর্ণ গড়ে ওঠেনি। গ্রাহকের মধ্যেও এমন মানসিকতা তৈরি হয়নি।
সরকার আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৩১ সালের নাগাদ শতভাগ কাগুজে নোটবিহীন লেনদেনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ নিয়ে বক্তারা বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। দেশে ক্যাশলেস লেনদেন নিশ্চিতে গ্রাহককে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা বাড়ানোয় জোর দিতে হবে।
আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ‘ক্যাশলেস লেনদেন, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো ও ফিনটেক সোসাইটি যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সহযোগিতা করেছে ফিনটেক প্রতিষ্ঠান ওয়েজলি ও টালিখাতা। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফিটনেক সোসাইটির সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান।
বৈঠকে বক্তব্য দেন বিল্ডকন কনসালট্যান্সির ম্যানেজিং পার্টনার মাহতাব আহমেদ, বিকাশের চিফ এক্সটারনাল ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিইসিএও) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম, মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, টালিখাতার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহাদাত খান, প্রিয় পে’র সিইও জাকারিয়া স্বপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মইনুল হোসেন, নগদের অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ আমিনুল হক, ব্র্যাক ব্যাংকের ডিএমডি এম সাব্বির হোসেন, প্রাইম ব্যাংকের ডিএমডি নাজিম চৌধুরী, যমুনা ব্যাংকের পরিচালক রেদওয়ান আনসারী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হেড অব ডিজিটাল ব্যাংকিং খালিদ হোসেন, ওয়েজলির হেড অব অপারেশন নাভিদ সারওয়ার প্রমুখ।
ফিটনেক সোসাইটির সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর মূল প্রবন্ধে ক্যাশলেস লেনদেনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তাঁর মতে, এখনো বেশির ভাগ গ্রাহক ক্যাশলেস বা নগদবিহীন লেনদেনে প্রস্তুত নন। ইন্টারনেট সুবিধা সবখানে সহজলভ্য নয়। গ্রাহকদের যথেষ্ট অ্যাকাউন্ট নেই। তহবিল সহজলভ্য নয়। তা ছাড়া ক্যাশলেস লেনদেনে তাৎক্ষণিক টাকা ওঠানোর সুযোগ নেই। এসব কারণে দেশে ক্যাশলেস লেনদেন কাঙ্ক্ষিত হারে এগোচ্ছে না।
বিল্ডকনের ম্যানেজিং পার্টনার মাহতাব আহমেদ বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেন এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আপনি গ্রামে গিয়ে নৌকা পার হবেন, সেখানে নগদ অর্থ ছাড়া আপনি কীভাবে ভাড়া পরিশোধ করবেন? বিতরণ কোম্পানিগুলোতে যাঁরা গ্রামাঞ্চলে কাজ করেন, তাঁরা কীভাবে ক্যাশলেস লেনদেন করবেন? কেউ বাড়িভাড়া দেবেন। কিন্তু ক্যাশলেশ লেনদেন করতে পারবেন না। মাহতাব আহমেদের মতে, ক্যাশলেশ লেনদেনের জন্য এখনো প্রয়োজনীয় সব ধরনের অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। দেশের মানুষেরও এমন মানসিকতা তৈরি হয়নি।
মাহতাব আহমেদ আরও বলেন, ভারতে ক্যাশলেস লেনদেন দিন দিন বাড়ছে। কারণ, সেখানে অবকাঠামো পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। সরকার চাইলে সেখান থেকে নীতিগত পরামর্শ নিতে পারে।
প্রিয় পে’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এখনো বিদেশি পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। কারণ এখনো আমাদের এমন সক্ষমতা হয়নি। ক্যাশলেস লেনদেনের প্রয়োজনেও দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করা উচিত। তা ছাড়া ক্যাশলেস লেনদেন ব্যর্থ হলে কাকে জবাবদিহি করা হবে কিংবা কাকে দায়ী করা হবে, তা ঠিক করাও জরুরি।
জাকারিয়া স্বপন আরও বলেন, ২০২৫ সালে দেশে ক্যাশলেস লেনদেন দেড় শতাংশ হয় কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। তাঁর মতে, ক্যাশলেস লেনদেন নিয়ে একটি বিস্তারিত ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। একটা প্রতিষ্ঠানকে এই পরিকল্পনার দায়িত্ব দিতে হবে। দেশে যদি একটা সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা করা যায়, তবে ২০৩১ সালে তা-ও ৩০ শতাংশ ক্যাশলেস লেনদেন করা সম্ভব হবে।
মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল মনে করেন, দেশে শতভাগ ক্যাশলেশ লেনদেন এখনই সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নগদ টাকার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, নগদ টাকায় কোনো কিছু কিনতে যদি ১০০ টাকা লাগে, খুচরা দোকানে ডিজিটাল পেমেন্ট দিয়ে সেই জিনিসটা কিনতে ১০৫ (ভ্যাটসহ) টাকা লাগে।
সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, কার্ড এবং এমএফএস মিলে মাসে ৭৫ হাজার কোটি টাকার ক্যাশআউট হলে পেমেন্ট হয় ১৫ হাজার কোটি টাকা। শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেন করতে চাইলে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকার ব্যবহার নিরুৎসাহিত অথবা ক্ষেত্র বিশেষে অতিরিক্ত চার্জ অর্পণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সাব্বির হোসেন বলেন, যাঁরা ক্যাশলেশ লেনদেন করছেন না, আর যাঁরা পারছেন না, কেন তা হচ্ছে, সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। অনেকের ইন্টারনেট সুবিধা নেই। অনেকের অ্যাকাউন্ট নেই। এখন প্রয়োজন ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া হয়।
সাব্বির হোসেন বলেন, ‘ক্যাশলেস লেনদেনে সবচেয়ে বড় সমস্যা সদিচ্ছার ঘাটতি। এ বিষয়ে দেশে অভিজ্ঞ লোক নেই। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে এই খাতে লোক আনা যেতে পারে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মানুষ উচ্চ বেতনে এ দেশে পোশাক খাতে কাজ করছে। দেশে প্রযুক্তি সমস্যা নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে মানবসম্পদ। আমাদের মনোভাব এমন হতে হবে যেন ক্যাশলেস হতে না পারলে দেশের ক্ষতি হয় যাবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মইনুল হোসেন বলেন, মানবসম্পদের দুর্বলতার কারণে দেশে ক্যাশলেস লেনদেন তেমন এগোচ্ছে না। এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানসিকতা পরিবর্তন করা কঠিন। নামজারি করতে এখনো একবার সরকারি দপ্তরে যেতে হয়। এই একবার যদি শূন্য করা যেত, তাহলে সুফল মিলত।
মইনুল হোসেন বলেন, মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে কেন যাবে? মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করে না। মানুষকে যদি আস্থায় না নেওয়া হয়, সে কেন আসবে?
এই অধ্যাপকের মতে, মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার ভালোই জানে। যার উদাহরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ। ক্যাশলেস লেনদেন বাড়াতে প্রণোদনার বিকল্প নেই বলেও মত দেন তিনি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হেড অব ডিজিটাল ব্যাংকিং খালিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার আসলে ক্যাশলেস লেনদেন কতটা চায়, সেটা দেখার বিষয়। আপনি যখন ক্যাশলেস লেনদেন চাইবেন, তখন অবশ্যই সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) রুমে বসে ক্যাশলেস লেনদেন চাইতে পারি না।’ তিনি বলেন, ক্যাশলেস লেনদেন করতে গেলে প্রযুক্তি লাগবে, একটি পরিবারে অন্তত একটি স্মার্টফোনের ব্যবস্থা করতে হবে।
টালিখাতার সিইও শাহাদাত খান জানান, বাংলা কিউআর কোড ক্যাশলেস লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে যে কোন এমএফএস বা ব্যাংক–অ্যাপ গ্রাহক যেকোনো মার্চেন্টকে পেমেন্ট করতে পারেন। ইতোমধ্যে বিকাশ, রকেট, উপায় এবং ৩৪ টি ব্যাংক এই সেবা চালু করেছে।
শাহাদাত খান বলেন, একজন ব্যবসায়ী ক্যাশলেস পেমেন্ট নিবেন যদি সেবাটি সব সময় কাজ করে এবং প্রাপ্ত টাকা নগদের মত ব্যবহার করা যায়। ক্যাশলেস পেমেন্ট ছোট-বড় সব ধরনের লেনদেনের জন্য ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। সেবাটি জনপ্রিয় করার জন্য সব দোকান, ইনভয়েস এবং পোর্টালে কিউআর কোড অপশন রাখা দরকার - যেমন বিদ্যুৎ বিল, মেট্রোরেল টিকেট কেনা, হাসপাতাল কাউন্টার, ই-কমার্স পার্সেল এবং পেমেন্ট পোর্টাল।
যমুনা ব্যাংকের পরিচালক রেদওয়ান আনসারী বলেন, ক্যাশলেস লেনদেন করতে গিয়ে ভোক্তা ও বিক্রেতার মধ্যে কোনো বিতর্ক তৈরি হলে সেটির সমাধান হবে কীভাবে, সে পথ বের করতে হবে। কারণ এটি একটি জটিল বিষয়। তাঁর মতে, প্রণোদনা দেওয়া ছাড়া গ্রাহকেরা ক্যাশলেস লেনদেনে আগ্রহী হবেন না।
নগদের এএমডি আমিনুল হক বলেন, দেশে এখন অর্থনীতির কত শতাংশ ক্যাশলেস লেনদেন হয়, তার কোনো ভিত্তিরেখা নেই। আগে এটি জানা জরুরি। ক্যাশলেস লেনদেন করতে হলে পুরো ইকোসিস্টেমকে ক্যাশলেস করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার আগে সামাজিক সুরক্ষার ভাতা দিলে গ্রাহক সঙ্গে সঙ্গে পুরো টাকা তুলে নিত। এখন আর সেটি করছে না। গ্রাহক বিভিন্ন খাতে খরচ করছে। তবে শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেন চালু করতে হলে গ্রাহককে প্রণোদনা দিতে হবে।
বিকাশের বিকাশের চিফ এক্সটারনাল ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিইসিএও) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ক্যাশলেস লেনদেনের জন্য অবশ্যই একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। যেখানে স্পষ্ট করে লেখা থাকবে, কীভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে। বিকাশের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন বিগত ১৩ বছরে বিকাশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু আগামী সাড়ে ৬ বছরে শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেনের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা ও নীতিমালা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
প্রাইম ব্যাংকের ডিএমডি নাজিম চৌধুরী বলেন, ক্যাশলেস লেনদেনে আপনার কাছে অ্যাপ আছে, টুলস আছে। কিন্তু একটি ভালো মুঠোফোন নেই, ইন্টারনেট সুবিধা নেই। আপনার এক পাশ ভালো আরেক পাশ মন্দ, তাহলে হবে না। দুটো পাশেরই সমান্তরালভাবে উন্নতি করতে হবে।
ওয়েজলির পরিচালক নাভিদ সারওয়ার জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠান মূলত মুঠোফোনভিত্তিক সেবা দিয়ে থাকে। গ্রাহক আছেন আড়াই থেকে তিন লাখ। এসব গ্রাহক ২৪ ঘণ্টায় টাকা তোলার সুবিধা পেতে চান। গ্রাহক দুই দিন অপেক্ষা করতে চান না। ক্যাশলেস লেনদেন চালু করতে হলে ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মত দেন তিনি।
উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপিত আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১৯টি উপখাতের জন্য তিন বছরের জন্য কর অবকাশ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে শর্ত দেওয়া হয়েছে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেন করতে হবে।