একদিকে ডলার–সংকট, অন্যদিকে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দর। ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ছে। ব্যয় বাড়ছে ব্যবসার।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সামনে এসব কথা তুলে ধরে ব্যবসায়ীরা বললেন, তাঁরা বিপাকে রয়েছেন।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল রোববার ‘প্রাক্-বাজেট আলোচনা: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সভায় ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী।
সভায় আরও বলা হয়, দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সরকারের নীতির কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের ঘাটতি থাকার কারণেই এসব হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, তাঁরা যে ঋণ ৯ শতাংশ সুদে নিয়েছিলেন, সেখানে এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৪ শতাংশ সুদ। বাড়তি ৫ শতাংশ ব্যয়ের দায় কে নেবে।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী এসব বিষয় নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তিনি একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তাতে বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের জন্য একটি উৎসাহব্যঞ্জক বাজেট করা হবে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বেসরকারি খাতের মতামত ও প্রত্যাশাকে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ সভায় আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। তিনি বলেন, বাড়তি সুদের কারণে অনেকে খেলাপি হয়ে পড়বেন। এর জন্য ব্যবসায়ীদের তো কোনো প্রস্তুতি ছিল না।
এ কে আজাদ আরও বলেন, যাঁরা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন এবং বিনিয়োগ করলেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতায়নের দাবি করে তিনি বলেন, একটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গেল একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। বাংলাদেশ ব্যাংক তা জানত না। পরে তদন্ত করে এ ঘটনা বের করলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর বিকল্প নেই। সুদের ‘স্মার্ট রেটে’র পরিবর্তে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সুদহার একবারে অনেক বেড়ে যেত।
অবশ্য কনটেইনার ডিপো পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলী জওহর রিজভী বলেন, সুদের হারের ক্ষেত্রে যে ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি করা হয়েছে, তা আসলে ‘আনস্মার্ট’ হয়েছে।
সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির নতুন সংস্কৃতি শুরু হয়েছে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সরকারের নীতিই এ জন্য দায়ী। এ নীতির পর্যালোচনা দরকার, যাতে নতুন প্রজন্মে এ ধরনের খেলাপি তৈরি না হয়। করব্যবস্থা আরও সহজ করা দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম করের আওতা বাড়ানোর বিষয়ে বলেন, বিষয়টি যত সহজে বলা হয়, তত সহজ নয়। তিনি আরও বলেন, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে কীভাবে দেশের মধ্যে উৎপাদন বাড়ানো যায়, সে ধরনের করনীতি নেওয়া হয়েছে।
সভায় ব্যাংক একীভূতকরণের প্রসঙ্গও আসে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, কিছু ব্যাংক একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আফতাব উল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের একীভূতকরণ নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি আছে, প্রশ্ন আছে দুর্বলের সঙ্গে সবল ব্যাংকের একীভূতকরণ হলে কী ধরনের সমস্যা হবে।
একই ভীতির কথা জানান বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামও। তিনি সভায় বলেন, তাড়াহুড়া না করে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে এ পথে যাওয়া উচিত।
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি আশরাফ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংগঠনটির পক্ষ থেকে আগামী বাজেট সামনে রেখে আয়কর ও মূসক (মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট), আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং অবকাঠামো উন্নয়ন—এসব খাতের আলাদা সমস্যা চিহ্নিত করে প্রস্তাব দেয় ডিসিসিআই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল এবং অনুমোদিত বার্ধক্য তহবিল থেকে আয় করমুক্ত রাখার দাবি জানায় ঢাকা চেম্বার। তাদের প্রস্তাবে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া এবং সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান, সামীর সাত্তার ও শামস মাহমুদ; বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন।