অবশেষে জাতীয় শুল্কনীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। এরই মধ্যে খসড়া তৈরি হয়েছে। আইএমএফের মতো বিশ্বব্যাংকও চায় শুল্কনীতি হোক।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে কোনো শুল্কনীতি নেই। এতদিন তা করার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। শুল্কহার নির্ধারণ ও হ্রাস-বৃদ্ধিসহ সব চলছে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাড-হক)। শুল্কনীতি কে করবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নাকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এ নিয়েও ছিল ঠেলাঠেলি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি দল এক মাস আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে শিগগির জাতীয় শুল্কনীতি করার কথা বলে গেছে। এর পরই এ নীতি প্রণয়নে মনোযোগী হয়েছে সরকার। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকারের দপ্তরগুলোর কার্যতালিকা অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুল্কনীতি প্রণয়ন করবে।
যথাযথ শুল্ক কাঠামো দিয়ে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হওয়া দরকার। অথচ দেশ চলছে শুল্কনীতি ছাড়াই।জায়েদি সাত্তার, চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) এরই মধ্যে ৯ পৃষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছে। খসড়া নিয়ে পর্যালোচনা করতে গত সোমবার অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করেন বিটিটিসির চেয়ারম্যান মাহফুজা আখতার।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) জন্মলগ্ন থেকে এর সদস্য বাংলাদেশ। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশকেও ডব্লিউটিওর সদস্য হিসেবে শুল্কহারের বিষয়ে বিধিবিধান মানতে হয়। আইএমএফ বলে গেছে, অনেক পণ্য আমদানিতে এখনো বাংলাদেশের শুল্কহার বেশি, শুল্ক কাঠামোও জটিল। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে থাকার সময়ে শুল্কহার যৌক্তিক করা দরকার।
শুল্কনীতি পাশাপাশি ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব রোধে করণীয়, তৈরি পোশাকনির্ভরতা কাটিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ পরিস্থিতি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করা—এগুলো হচ্ছে আইএমএফের বাণিজ্যবিষয়ক চাওয়া।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুল্কহার কমানোর পথে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে গড় শুল্কহার ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী তা নামিয়ে আনতে হবে ২৫ শতাংশে। পরে আরও নামাতে হবে।
বিটিটিসির বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যথাযথ শুল্ক কাঠামো দিয়ে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হওয়ার দরকার। অথচ দেশ চলছে শুল্কনীতি ছাড়াই। রপ্তানিতে আমরা শুধু তৈরি পোশাক শিল্পে আটকে আছি। রপ্তানি তাই বেশি হচ্ছে না। একটা নীতির আওতায় শুল্কহার ও কাঠামো ঠিক করা হলে বাণিজ্য খাতই লাভবান হবে।’
৯ পৃষ্ঠার খসড়ায় এ সময়ে শুল্কনীতি করার পটভূমি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ৮০ দশকের প্রথম দিকে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা চালু করা হয়। তখন পোশাকশিল্পের কাঁচামালের শুল্কমুক্ত আমদানি নীতিও গ্রহণ করা হয়। একই দশকে আমদানি লাইসেন্স নিবন্ধন পদ্ধতি বাতিলের পাশাপাশি আমদানিনীতি শিথিল করা হয়। পরের দশকে শুরু করা হয় শুল্কহার যৌক্তিকীকরণের (কমানো) প্রক্রিয়া, যা অব্যাহত থাকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তবে রাজস্ব ক্ষতি ও শুল্কহার কমার কারণে দেশীয় শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় শুল্কহার কমানোর পথে যায়নি সরকার।
বলা হয়েছে, টেকসই শিল্পোন্নয়ন, দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শুল্ক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা দরকার।
রপ্তানি শুল্ক, আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক এবং সরকার আরোপিত অন্য কোনো কর বা শুল্ক যা বাণিজ্য নিরপেক্ষ নয়, এমন সব শুল্ক প্রস্তাবিত শুল্কনীতির আওতায় থাকবে। এ ছাড়া এ নীতির আওতায় থাকবে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে আরোপযোগ্য শুল্ক ও করবিষয়ক সব বিধিবিধান। বলা হয়েছে, শুল্ক কাঠামো সহজ করা এবং অপ্রয়োজনীয় জটিলতা পরিহার করাই হবে শুল্কনীতির উদ্দেশ্য।
দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শুল্ক প্রতিরক্ষণ হার ধাপে ধাপে কমানো, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটকে বাণিজ্য নিরপেক্ষ শুল্কে পরিণত করা, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক শুধু জরুরি পরিস্থিতিতে আরোপ এবং ডব্লিউটিওর সঙ্গে সংগতি রেখে ন্যূনতম আমদানিব্যবস্থা বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়েছে খসড়া নীতিতে।
খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত বিটিটিসির সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন শুল্ক বিন্যাস করে কোনো ধরনের নীতি ছাড়াই। এভাবে আর তা চলতে পারে না। আইএমএফ যেমন শুল্কনীতি করার কথা বলে গেছে, বিশ্বব্যাংকও চাচ্ছে তা হোক। আশা করা যায়, ছয় মাসের মধ্যেই একটা নীতি হবে।’