মতিঝিলে মেট্রোরেল স্টেশনের পাশে একসঙ্গে কয়েকটি অস্থায়ী খাবারের দোকান আছে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এসব হোটেলের নিয়মিত ক্রেতা। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে গিয়ে যায়, সব কটি দোকানই ফাঁকা। একটি দোকানের ব্যবস্থাপক ও বাবুর্চি মো. সুমন অলস বসে আছেন।
ব্যবসা কেমন চলছে, জানতে চাইলে মো. সুমন গামছা দিয়ে ঢেকে রাখা পরোটার খামি দেখিয়ে বলেন, ক্রেতা থাকলে তো এগুলো থাকত না। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার বাবদ ৮-৯ হাজার টাকার বিক্রি হয়। গতকাল (সোমবার) বিক্রি করেছি মাত্র আড়াই হাজার টাকা। অবস্থা এমন যে দুজন কর্মীর বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছেন মালিক।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অস্থায়ী এই খাবারের দোকানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রেস্তোরাঁমালিকেরা বলছেন, কারফিউ জারির প্রথম তিন-চার দিন অধিকাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। এরপর রেস্তোরাঁ খুললেও ক্রেতা তেমন নেই। এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রেস্তোরাঁভেদে বিক্রি ৫০-৭০ শতাংশ কম। করোনার পর দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা বলে জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের সড়কে চুঁই–লঙ্কা রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টায় গিয়ে কয়েকজন ক্রেতা দেখা গেল। রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মো. মিজান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য সময়ের তুলনায় বেচাবিক্রি অর্ধেক হয়ে গেছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমাদের মূল ক্রেতা। বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটায় অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ায় অনেক নিয়মিত ক্রেতাই এখন আর রেস্তোরাঁয় খাচ্ছেন না।’
মতিঝিলের এফবিসিসিআই কার্যালয়ের পাশের ভবনের সরষে ইলিশ রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা গেল, হাতে গোনা ক্রেতা। রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক টেবিল বসে হিসাব করছেন। বললেন, স্বাভাবিক সময়ে দিনে ৫০-৬০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এখন ১২-১৩ হাজার টাকারও বিক্রি হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই থেকে দেশজুড়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই, শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। বন্ধ হয়ে যায় শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ২৩ জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে শিল্পকারখানা চালু হয়। সরকার-বেসরকারি অফিস চালু হয় গত বুধবার।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে রাজধানীর বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ ব্যবসার একটা অংশ অনলাইননির্ভর। কিন্তু ১৭ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট ও পরদিন থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনলাইনে বেচাবিক্রিও বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি ইন্টারনেট সচল হলেও অনলাইনে খাবার বিক্রি খুব একটা বাড়েনি।
রেস্তোরাঁ ব্যবসায় অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ড সুলতান ডাইন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ১৪টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে তাদের। কোটা আন্দোলনের কারণে ১৬ জুলাই থেকে বিক্রি কমে যায় ব্র্যান্ডটির। কারফিউর প্রথম চার দিন বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ রাখার পর চালু করা হয়। যদিও গত এক সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৬০-৬৫ শতাংশ কম। দুই দিন ধরে অনলাইনে ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করলেও তা খুবই সামান্য।
আমরা রেস্তোরাঁমালিকেরা খুবই সংকটে পড়েছি। ইতিমধ্যে দুই সপ্তাহের ব্যবসা হারিয়েছি। এখনো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাতে ব্যবসায়ও অনিশ্চয়তা ভর করেছে।আনোয়ার হোসেন মৃধা, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি
সুলতান ডাইনের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মো. আলম বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় দেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসা করোনার পর আবার বড় ধাক্কা খেল। দুই সপ্তাহ ধরে ব্যবসা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মাস শেষ হলেই কর্মীদের বেতন, বিক্রয়কেন্দ্রের ভাড়া, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেই হবে। সব মিলিয়ে জুলাইয়ে বড় লোকসান গুনতে হবে।
দেশের কত রেস্তোরাঁ রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট হোটেল ও রেস্তোরাঁ ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪ টি, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি। দেশের হোটেল রেস্তোরাঁর মধ্যে সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৫২টি। বাকি সব ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরের রেস্তোরাঁ ব্যবসাও ক্ষতির মুখে পড়েছে। বগুড়ার সৈকত রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম সরকার বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন বিক্রি ৬০ শতাংশ কম। পরিস্থিতি যেদিন একটু ভালো থাকে, সেদিন ১০-২০ শতাংশ বিক্রি বাড়ে। ব্যবসা কমে যাওয়ায় ২০ শতাংশ কর্মীকে পালা করে কাজ থেকে বিরত রাখা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রেস্তোরাঁমালিকেরা খুবই সংকটে পড়েছি। ইতিমধ্যে দুই সপ্তাহের ব্যবসা হারিয়েছি। এখনো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, সেটি কেউ বলতে পারছে না। তাতে ব্যবসায়ও অনিশ্চয়তা ভর করেছে।’