দেশে চলমান ডলারের সংকটের এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। তবু বৈদেশিক লেনদেনের প্রধান এ মুদ্রা নিয়ে অস্থিরতা কমেনি। খোলাবাজারে ডলার মিলছে না। ব্যাংকেও পর্যাপ্ত ডলার নেই।
দেড় বছর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ডলার-সংকট পড়ে। কারণ, তখন বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বাড়তে শুরু করে। এতে আমদানি খরচ হঠাৎ করে বেড়ে যায়। ডলারের দাম তখন ছিল ৮৬ টাকা, যা বেড়ে এখন ১১০ টাকায় উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ডলারের দাম ধরে রেখেছিল। এখন অবশ্য ব্যাংকগুলো ডলারের দাম ধরে রাখছে। ফলে জোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে এখনো নিয়মিত ডলারের দাম নির্ধারণ হচ্ছে না। তবে ডলারের যে প্রকট সংকট, তা কিছুটা কমে এসেছে। কারণ, ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ খানিক বেড়েছে।
গত দেড় বছরে দেশে ডলারের দাম প্রায় ২৮ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে। যেমন গত আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
একইভাবে নগদ ডলারের দামও বেশ বেড়েছে। ব্যাংকগুলোতে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১১০ টাকা হলেও খোলাবাজারে তা ১১৭-১১৮ টাকায় উঠেছে। আগের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী, রোগী ও পর্যটক বিদেশে যাওয়ায় নগদ ডলারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন মুদ্রাটির দাম বেড়ে গেছে। এ জন্য দায়ী বিভিন্ন মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করার পাশাপাশি ব্যাখ্যাও তলব করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় কিছু ব্যাংকেরও ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের সংকট সমাধানে এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সবই অস্থায়ী ভিত্তিতে। সংকট কমবে, এমন কোনো কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। ডলার-সংকটের জন্য যাঁরা দায়ী, বিশেষত অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। এটা না করে উল্টো বেশি দামে ডলার কেনা-বেচা করায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা সংকট আরও উসকে দিচ্ছে। ফলে গত আগস্টে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের পতন হয়েছে।
ডলারের কারণে অনেকে ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন। আবার ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে গেছে। এ জন্য ডলার-সংকটের বিষয়টিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই সময়ে উচ্চপর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বিষয়টি আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করতে হবে।মুস্তফা কে মুজেরী সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
কবে নাগাদ ডলারের সংকট কাটবে, তা কেউই বলতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভাবছে, ডলার-সংকট কবে কাটবে, তা জানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মুখপাত্র মেজবাউল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
ডলার-সংকট কবে কাটতে পারে, তা জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের সংকট আগের চেয়ে কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমরা বিষয়টি নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ডলারের সংকট কেটে গেছে তখনই বলা যাবে, যখন আন্তব্যাংকে ডলার কেনাবেচা স্বাভাবিক হবে। তার আগে এ নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন।’
রাশিয়া গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯১৬ কেটি ডলার। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি খরচ ছিল ৬ হাজার ৫৫৯ কোটি ডলার। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ধরে রাখে। পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে ব্যাংকগুলোর হাতে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে ডলারের সংকট কাটেনি। সংকটের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি খরচ কমে হয় ৭ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার।
এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৪৩২ কোটি ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। গত বছরের একই মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৬৩৫ কোটি ডলারের। সে হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত জুলাইয়ে এলসি খোলা কমেছে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ। ডলারের সংকটের কারণে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন। তবে গাড়ি আমদানি বেড়েছে, বিলাসপণ্যও আসছে দেদার।
ব্যাংকাররা বলছেন, চাহিদা ও সরবরাহ অনুযায়ী যখন ডলারের দাম নির্ধারিত হবে, তখনই সংকট কাটবে। দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে হয়তো প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২০-১২৫ টাকায় উঠে যাবে। তখন আবার সরবরাহও বাড়তে পারে। আর সরবরাহ বাড়লে দাম আবার কমে আসবে। এতে ডলার নিয়ে যে আতঙ্ক, তা-ও কেটে যাবে।
গত বছরের শেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) থেকে এখন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।
চলতি সেপ্টেম্বর থেকে আমদানিকারকদের কাছে ১১০ টাকায় ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো। আগে আমদানি দায় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করত। এদিকে পণ্য বা সেবা রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কেনায় ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসীদের প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা এবং রপ্তানিকারকদের প্রতি ডলারের জন্য ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিত। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে ডলার কেনা-বেচা করায় সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১০টি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে। এ কারণে গত আগস্টে প্রবাসী আয় ২১ শতাংশের বেশি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ডলার-সংকট তৈরি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও নীতি নেওয়া হয়েছে। তবে কোনোটাই পূর্ণাঙ্গভাবে কাজে আসেনি। কাজ হলে সংকট এত দিনে কেটে যেত। এখনো ডলারের দাম নিয়ে আতঙ্ক থাকত না। এ জন্য নতুন করে ভাবার সময় এসেছে, কী নীতি নিলে সংকট কেটে যাবে। ডলারের দাম বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করাটাই একমাত্র সমাধান।
মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, ডলারের কারণে অনেকে ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন। আবার ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে গেছে। এ জন্য ডলার-সংকটের বিষয়টিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই সময়ে উচ্চপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করতে হবে।
এদিকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) আমদানি দায় পরিশোধ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত আরও কমেছে। জুলাই-আগস্ট মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করায় বাংলাদেশ ব্যাংকে গতকাল রোববার রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৭৬১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২ হাজার ১৪৪ কোটি ডলার হওয়ার কথা। আর প্রকৃত রিজার্ভ ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের কম।
গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৯২০ কোটি ডলার। সেদিন আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩০৬ কোটি ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। সরকারি আমদানি মেটাতে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে।