ব্যাংক খাতে চলমান অনিয়ম, লুটপাট ও অর্থপাচারের তথ্য চেপে রাখতেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, সাংবাদিকেরা সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকেন। নানা ভালো কাজ ও অনিয়ম তুলে ধরে জনস্বার্থে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা রাখেন। এসব ভূমিকা পালন করা থেকে সাংবাদিকদের সরিয়ে রাখতে এবং তাঁদের মাধ্যমে ভুল ও অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এই প্রশ্ন রাখেন নেতারা?
সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা আসন্ন ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে এখনই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।
আজ বুধবার অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা আরোপ বিষয়ে নেতৃবৃন্দকে অবহিতকরণ’ শীর্ষক এক সভায় সাংবাদিক নেতারা নিজেদের অভিমত দেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সম্পাদক আবুল কাশেম।
সভায় বক্তব্য দেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী ও অপর অংশের সভাপতি শহিদুল ইসলাম; বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম; ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ, সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন; ইআরএফের সাবেক সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ; ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন; ইআরএফের সাবেক সভাপতি মনোয়ার হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, জিয়াউর রহমান ও এস এম রাশিদুল ইসলাম এবং সিনিয়র সাংবাদিক সোহেল মঞ্জুর।
ইআরএফের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ও ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করলে তাদের সমস্যা হয়। এ কারণেই সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। তারা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এমন করছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ব্যাংক খাত থেকে একজন পি কে (প্রশান্ত কুমার) হালদার আট হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যাবেন, অথচ কিছু বলা যাবে না, এটা তো হতে পারে না। একজন ব্যক্তি সাত-আটটি ব্যাংকের মালিক কীভাবে হলেন? আবার নতুন একটি ব্যাংকের মালিকানা তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলাও কঠিন। কারণ, তাঁদের পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন আছে।
গণমাধ্যম হল–মার্কসহ সব কটি আর্থিক অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করে সরকারকে সহযোগিতা করেছে বলে উল্লেখ করেন শ্যামল দত্ত। তিনি বলেন, বাজেট আসছে। এমন এক সময়ে কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে?
শ্যামল দত্ত আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে যে নৈরাজ্য চলছে, তারই একটি অংশ হচ্ছে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে না দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে আট হাজার কোটি টাকা চুরি হয়ে গেছে, এতে কি চোরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসতে হয়েছে? সাংবাদিকদের প্রতিবেদনগুলো সরকারকে সাহায্য করে। তাই আরও জোরেশোরে আন্দোলন করতে হবে।
বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘ব্যাংক বিটের রিপোর্টাররা আজ সমস্যায় পড়েছেন, এটা আরও বাড়বে। ধীরে ধীরে সাংবাদিকেরা আরও সমস্যার সম্মুখীন হবেন। দল–মতের বাইরে এসে পেশাদারত্বের জায়গায় আমাদের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। শেয়ারবাজার ও ডলারের বাজারে যেসব অপকর্ম করা হয়, এগুলো তো কর্মকর্তারাই ঘটান, সাংবাদিকেরা শুধু তা তুলে ধরেন।’
ডিইউজের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন এক গভর্নরকে বসানো হয়েছে, যিনি এই পদের যোগ্যই নন। তাঁর যে দুর্বলতা আছে, সেটি ঢাকার জন্যই তিনি সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। বর্তমান গভর্নরের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সূচকেই সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই ডলারের দাম একলাফে সাত টাকা বাড়িয়ে দিলেন কিসের ভিত্তিতে? কিছু পীর-আউলিয়া-দরবেশদের সুবিধা দিতে গিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা দরজায় খিল দিয়েছেন, কিন্তু দরজা বন্ধ করতে পারেননি।
বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং খাতে এখন আড়তদার তৈরি হয়েছে। ফলে একজনই অনেক ব্যাংকের মালিক। এ ছাড়া রিজার্ভ চুরি ও ভল্টের সোনা চুরি এসব খবর যেন জনগণের সামনে না আসে, সে জন্য চোরদের পাহারা দিতেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বলেছেন, “আসা-যাওয়া করতে থাকো, ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু দেড় মাস পার হলেও এখনো আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক ভাইয়েরা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারছেন না। আগে সাংবাদিকেরা যেভাবে সহজে যেকোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন, তা এখন পারছেন না।’
ইআরএফ সভাপতি আরও বলেন, ‘গভর্নর আমাদের দেশপ্রেমিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আমাদের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক লোক আর দেখছি না। আমরা যা করি, তা দেশের জন্যই করে থাকি। সহকর্মীরা বলছেন যে তাঁদের ফোন ট্র্যাকিং করা হচ্ছে, যা খুবই ভয়ানক ব্যাপার। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচিতে যেতে হবে।’
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, সাত কার্যদিবসের মধ্যে গভর্নর সাহেবকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে অতি দ্রুত সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মুখপাত্রের কাছে কোনো তথ্য চাওয়া হলে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিকদের প্রদান করতে হবে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি শুকুর আলী শুভ বলেন, সাংবাদিকদের তথ্য দিতেই হবে। তাঁরা কোনো ব্যক্তির জন্য কাজ করেন না। পুরো দেশের জন্যই তাঁরা কাজ করেন।
ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার দুর্নীতির ফাইল জমা হয়ে আছে। এসব বিষয় নিয়ে কাজ করলে তাঁরা নিজেরাই আমাদের কাছে চলে আসবেন।’
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, টাকা ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ানো হচ্ছে। সরকার যদি মনে করে যে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিষেধাজ্ঞা থাকলে সরকার অনেক কিছু আড়াল করে ভালো থাকবে, তাহলে তা ভুল। বরং সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ করতে দিলে অর্থনীতি আরও ভালো থাকবে। দুর্নীতিগুলো সামনে আসবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নাগরিক প্রতিষ্ঠান। আর নাগরিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য জনগণের পাওয়ার অধিকার রয়েছে।