একসময় সারা দেশে তিন লাখের মতো স্টুডিও ছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ছবি তোলার পরিমাণ বাড়লেও কমে গেছে স্টুডিওর সংখ্যা। তাতে ব্যবসাটি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। স্টুডিও ব্যবসার একাল–সেকাল নিয়ে এবারের মূল আয়োজন।
আশির দশকে রাজধানীর পুরান ঢাকার হাটখোলা এলাকায় এক সারিতে অর্ধশত ছবি তোলার স্টুডিও ছিল। জায়গাটি তখন ঢাকাবাসীর কাছে পরিচিত ছিল ‘স্টুডিওপাড়া’ নামে। কাছাকাছি সময়ে নিউমার্কেট এলাকায়ও ছিল ১২-১৫টি স্টুডিও। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ছবি তোলার পরিমাণ বাড়লেও কমে গেছে স্টুডিওর সংখ্যা। তাতে হাটখোলা, নিউমার্কেটসহ সারা দেশের স্টুডিও ব্যবসা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।
দেশের স্টুডিও ব্যবসায়ীদের সমিতি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্য অনুসারে, একসময় সারা দেশে তিন লাখের মতো স্টুডিও ছিল। তখন সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল স্টুডিও। এখন সেই সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজারে নেমে এসেছে। আর রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে কয়েক শ স্টুডিও রয়েছে।
সব স্টুডিওতে ছবি তোলা গেলেও ভালো মানের কাগজে ল্যাব প্রিন্ট করার যন্ত্র সবার কাছে নেই। যাদের কাছে এই প্রিন্ট করার যন্ত্র আছে, সেগুলো ‘স্টুডিও ল্যাব’ নামে পরিচিত। রাজধানীতে এ রকম স্টুডিও ল্যাবের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। আর সারা দেশে এই সংখ্যা খুব বেশি নয়।
রাজধানীর মগবাজারের পদ্মা স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী আক্কাস মাহমুদ জানান, একটা সময় রাজধানীর হাটখোলা রোডকে বলা হতো স্টুডিওপাড়া। ইত্তেফাক মোড় থেকে অভিসার সিনেমা হল হয়ে টিকাটুলী পর্যন্ত রাস্তায় এক সারিতে অর্ধশতের বেশি স্টুডিও ছিল। এমনিতে তো ভিড় থাকতই, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে সেখানে ছবি তোলার লম্বা লাইন লেগে যেত। মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সেখানে বেশি যেতেন।
আক্কাস মাহমুদ আরও জানান, একই সময়ে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গড়ে ওঠে বেশ কিছু স্টুডিও। তবে সেখানে যেতেন একটু অভিজাত শ্রেণির লোকেরা। এ ছাড়া ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড, জিগাতলা, ফার্মগেট, গুলশান, মিরপুর-১, লালবাগসহ বিভিন্ন স্থানে স্টুডিও অঞ্চল গড়ে ওঠে। এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই।
বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কালার ল্যাবে ছবি প্রিন্টের ক্ষেত্রে আগে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের নিয়ম ছিল। তবে ব্যবসায় মন্দা শুরু হলে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে তা কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। এরপর ২০১৩ সালের দিকে স্টুডিও ব্যবসাকে রুগ্ণ শিল্প বিবেচনা করে এই খাতে ভ্যাট মওকুফ করা হয়। তারপরও স্টুডিও ব্যবসা টিকে থাকছে না।
একসময় দেশে সাদাকালো বক্স ক্যামেরায় ছবি তোলা হতো। এরপর আসে পিনহোল, এসএলআর ও কমপ্যাক্ট ইত্যাদি ফিল্ম ক্যামেরা। ২০০০ সালের দিকে ছোট ডিজিটাল ক্যামেরা এলে তা ক্রমে মানুষের হাতে হাতে চলে যায়। এর মধ্য দিয়ে ফিল্মের ধরাবাঁধা সীমার পরিবর্তে কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়। তারপর ডিএসএলআর ক্যামেরা এলে ছবি তোলার প্রক্রিয়া আরও আধুনিক হয়। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে গত দেড় দশকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের বিস্তারের ফলে।
স্টুডিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের হাতে হাতে ক্যামেরা চলে আসায় এখন আর ছবি তোলার জন্য সচরাচর স্টুডিওতে যেতে হয় না। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া ছবি প্রিন্টও করান না কেউ। আবার সাধারণ কাজের জন্য যেসব ছবি লাগে, তা বিভিন্ন ফটোকপি-প্রিন্টের দোকান থেকে কম দামের কাগজে করিয়ে নেওয়া যায়।
এসব কারণে স্টুডিওতে ছবি তোলার চাহিদা অনেকে কমেছে। আর স্টুডিওর গ্রাহকসংখ্যা কমে যাওয়ায় লোকসানে পড়ে ব্যবসা ছেড়েছেন অনেক স্টুডিও মালিক। আগের অনেক সফল স্টুডিও ব্যবসায়ী এখন অন্য ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
রাজধানীর লালমাটিয়া মোড়েই অবস্থিত ৩৫ বছরের পুরোনো কালার ওয়ার্ল্ড ডিজিটাল ফটো স্টুডিও। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাজেদ এ এ আদেল জানান, ২০০০ সাল নাগাদ শ্যামলী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত পুরো ধানমন্ডি এলাকায় ১২-১৫টির মতো স্টুডিও ল্যাব ছিল। তবে ২০০৬ সালের পর থেকে কমতে শুরু করে এই সংখ্যা। এখন মাত্র চার-পাঁচটি ল্যাব পাওয়া যাবে এ এলাকায়। প্রযুক্তির কারণে মানুষের ছবি তোলার অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে স্টুডিও ব্যবসাও হারিয়ে যাচ্ছে।
সেই সাদাকালো ছবির সময়েও ভালো স্টুডিওগুলোতে ৮-১০ জন করে কর্মী কাজ করতেন বলে জানান সাজেদ আদেল। আর এখন তা দুই-তিনজনে নেমে এসেছে। এখন দোকানভাড়া দিয়ে স্টুডিও পরিচালনা করা অসম্ভব বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু যাঁদের নিজেদের মালিকানায় দোকান আছে, তাঁরাই এই ব্যবসা ধরে রেখেছেন বলে জানান তিনি।
আদেল আরও বলেন, ‘অনেকটা মায়া থেকে আমি আমাদের প্রতিষ্ঠানটি ধরে রেখেছি। পুরোনো কর্মীদেরও বাদ দিইনি। তবে স্টুডিওটি এখন একটি কক্ষে নিয়ে এসেছি। অন্য কক্ষে ক্রোকারিজ পণ্য বিক্রি করা হয়।’
বর্তমানে নিউমার্কেটে থাকা একমাত্র স্টুডিওটির নাম ফটো মুভি অ্যান্ড স্টিলস স্টুডিও। সেই ১৯৫৮ সাল থেকে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বৃহস্পতিবার স্টুডিওটিতে গিয়ে কথা হয় এটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে এখানে কাজ করছেন। স্বাধীনতার পরে নিউমার্কেট এলাকায় ১৮টি স্টুডিও ছিল বলে জানান জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে একটিতে। ২০০০ সালের দিকে এখানে আকস, লিমা, হানসা ও ফটোমুভি—চারটি স্টুডিও ছিল। সেই সময় প্রতিদিন শতাধিক মানুষ আসতেন স্টুডিওগুলোয়। আর এখন দিনে ১৫-২০ জনের বেশি লোক আসেন না। আশির দশকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ২০ টাকার মতো। আর তখন আমরা এক কপি রঙিন ছবি প্রিন্ট করে
দিতাম ১৫ টাকায়।
জিল্লুর রহমান বলেন, আগে ছবি তোলা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা, ফিল্ম ও অ্যালবাম ইত্যাদি পণ্য বিক্রি হতো স্টুডিওতে। এখন শুধুই ছবি তোলা ও প্রিন্ট করার জন্য মানুষ স্টুডিওতে যান।
এ সময় প্রতিষ্ঠানটির আরেক কর্মী জাহিদুর রহমান বলেন, আগে বিনোদনের জায়গা ছিল দুটি—ছবি তোলা আর ছবি (সিনেমা) দেখা। এখন সেই অবস্থা আর নেই। এখন মূলত দাপ্তরিক কাজের জন্য মানুষ স্টুডিওতে আসে।
ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতার আগে দেশে মূলত সাদাকালো ছবিই তোলা হতো। ১৯৭২ সালের দিকে দেশে প্রথম রঙিন ছবির প্রচলন হয়। সে ক্ষেত্রে ছবি তুলে তা জাপান, হংকং, ব্যাংকক, ভারত, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ থেকে প্রিন্ট করে আনা হতো। ১৯৭৯ সালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে স্থাপন করা হয় দেশের প্রথম রঙিন ছবির স্টুডিও ফুজি কালার ল্যাব ও স্টুডিও।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইজাহার খান ইমরান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর দেশে রঙিন ছবির চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। তবে অন্য দেশ থেকে ছবি প্রিন্ট দিয়ে আনা ছিল সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। এ জন্য আমরা জাপানের ফুজি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে প্রথম কালার ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নিই।’
একসময় সারা দেশে ১১২টি শাখা খোলে ফুজি। তাদের দেখাদেখি পরে জাপানি কনিকা, যুক্তরাষ্ট্রের কোডাক ও জার্মানির আগফা কোম্পানি কালার ল্যাব স্থাপন ও ফিল্ম বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে। একসময় দেশে কনিকার প্রায় ৪০টি, কোডাকের ২৫টি ও আগফার ১২টির মতো স্টুডিও ছিল। বর্তমানে ফুজি ছাড়া আর কারোরই কার্যক্রম নেই। তবে ফুজির স্টুডিও আছে মাত্র ৩২টি।
রাজধানীর পদ্মা স্টুডিওর মালিক আক্কাস মাহমুদ জানান, ২০০০ সালের দিকে দেশে ফিল্মবিহীন ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলার প্রযুক্তি চলে আসে। ফলে তখন আর ছবি তোলার পরে নেগেটিভের ঝামেলা থাকল না। একই সময়ে ফটোগ্রাফির কাজে কম্পিউটারের ব্যবহারও শুরু হয়। এতে ছবি এডিট বা সম্পাদনা এবং প্রিন্ট করা আরও সহজ হয়ে যায়। আগে ছবি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট আকারে প্রিন্ট করা হতো। পরে কম্পিউটারে ছবির আকার ছোট–বড় করা সম্ভব হয়। এরপর ছবি তোলার ক্যামেরায় বিভিন্ন আধুনিকায়ন হলেও অন্যান্য প্রযুক্তি মোটামুটি একই রয়ে গেছে।
সময়ের আবর্তে ঢাকার মধ্যে বেশ কিছু স্টুডিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে কিছু বন্ধ হয়ে গেছে, আর কিছু এখনো টিকে আছে। জনপ্রিয় স্টুডিওগুলোর মধ্যে রয়েছে লালবাগের ম্যানিলা, গুলশানের কুইক ফটো, গ্লিটার ও ভিআইপি স্টুডিও, বেইলি রোডের ফটোম্যাটিক, হাটখোলা রোডের স্টুডিও ২৭, আরামবাগের ডালাস, এলিফ্যান্ট রোডের ফুজি ও মাস্টার কালার, নিউমার্কেটের ফটোমুভি অ্যান্ড স্টিলস, ধানমন্ডির ফটোহাট ও মান্নাস হ্যাভেন, লালমাটিয়ার কালার ওয়ার্ল্ড, মিরপুর-১ এলাকার এশিয়া স্টুডিও, মগবাজারের পদ্মা স্টুডিও ইত্যাদি।
বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টুডিওগুলোর মধ্যে হাটখোলার পামেলা, হলিউড, রাজী, সোনারগাঁও ও বিথি, ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকার মিউজিক্যাল মার্ট, ধানমন্ডির কনিকা, নিউমার্কেটের আকস স্টুডিও, এলিফ্যান্ট রোডের আঁকাবাঁকা প্রভৃতি ছিল অন্যতম।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভিসার কাজের জন্য অনেক দূতাবাস এখনো নির্দিষ্ট কালার পেপারে ছবি চায়। এসব ক্ষেত্রে ছবি সাধারণ ইনজেক্ট পেপারে দিলে দূতাবাস তা গ্রহণ করে না। ফলে এ ধরনের কাজে মানুষ স্টুডিওমুখী হন। যাঁরা দীর্ঘদিন ছবি সংরক্ষণ করে রাখতে চান, তাঁরা আসল কালার পেপারে ছবি প্রিন্ট করিয়ে অ্যালবামে বা বাঁধাই করে রাখেন। এ ছাড়া বিয়ে, জন্মদিন, মডেলিং ইত্যাদি কাজে এখনো স্টুডিওর চাহিদা আছে।
দেশে ফটোগ্রাফির ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই খাতের কোনো জিনিসই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় না। বিভিন্ন প্রকারের ক্যামেরা থেকে শুরু করে ফিল্ম, ল্যাব যন্ত্র, রাসায়নিক ও কাগজ—সব পণ্যই আমদানিনির্ভর। রাজধানীর পল্টন মোড় ও বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে দেশের স্টুডিওর পণ্যগুলো পাওয়া যায়।
১৯৭৮ সাল থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে ক্যামেরা বিক্রি করছে বায়োনিক ক্যামেরা হাউস। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে ফিল্ম ক্যামেরা বিক্রি একদম কমে যায়। এরপর ডিজিটাল ক্যামেরা ভালো বিক্রি হতো। সেটাও এক দশক হয় বিক্রি হচ্ছে না। এখনো কেউ কেউ এসে ফিল্ম ক্যামেরার কোঁজ করেন, তবে আমরা দিতে পারি না। ফিল্ম ক্যামেরার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে ফিল্ম আমদানি এবং বিক্রিও।’