জিডিপির অনুপাতে ঋণ এখনো সহনীয়। তবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় না বাড়লে ঋণ পরিশোধ কঠিন হবে।
বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বাড়ছে। আট বছরে এই ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নেওয়া বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি মার্কিন ডলারে, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৭৪ ডলারে (প্রায় ৬৩ হাজার টাকা)। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি।
বিদেশি ঋণ নিয়ে সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। করোনাকালে টিকাদান ও অন্যান্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতও বিনিয়োগের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ হার প্রায় ২২ শতাংশ। তবে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ না বাড়লে ঋণ পরিশোধ কঠিন হতে পারে। উদ্বেগের দিক হলো, ঋণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না।
সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণের কারণে অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না।বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন
অর্থনীতিবিদেরা কঠিন শর্তের ঋণ নিয়েও সতর্ক করেছেন। তাঁরা বলছেন, কঠিন শর্ত ও বাড়তি সুদে ঋণ নেওয়া হলে তা অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জিডিপির অনুপাতে ঋণ কতটা, তা বড় বিষয় নয়। যেমন জাপানের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে ১০৪ শতাংশ। কিন্তু দেশটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন চাপে নেই। বিপরীতে পাকিস্তানের বিদেশি ঋণ জিডিপির ৩৫ শতাংশের কিছু কম; কিন্তু দেশটি ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণের কারণে অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না।
জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের সরবরাহ ঠিক না থাকলে এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা উন্নত না করে ব্যয়বহুল দ্বিপক্ষীয় ঋণ নেওয়া অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এসব ঋণ দুর্দশার কারণ হতে পারে।
সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এই সব ঋণ নেওয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেশের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান রয়েছে। তাতে দুটি হিসাব পাওয়া যায়। একটি জুন শেষে বিদেশি ঋণের হিসাব। অন্যটি সেপ্টেম্বর শেষের হিসাব। তবে সেপ্টেম্বরের হিসাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। জুনের হিসাবে দেখা যায়, বিদেশি ঋণের বড় অংশ (৭৭ শতাংশ) সরকারি খাতের। বাকিটা (২৩ শতাংশ) বেসরকারি খাতের।
বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংক ও বহুপক্ষীয় সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, উৎপাদনমুখী শিল্প খাত, বাণিজ্য, নির্মাণ ইত্যাদি খাতে। বিদেশি ঋণ সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক, তা পরিশোধ দেশের অর্থনীতির ওপরই চাপ তৈরি করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে বিভিন্ন বহুপক্ষীয় সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯২৩ কোটি ডলার। দ্বিপক্ষীয় অর্থাৎ কোনো দেশের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলার। বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৮৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের ৮৩ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি। বাকিটা স্বল্পমেয়াদি। সরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম। বেসরকারি খাতে বেশি।
সরকারি খাতের বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের নিজস্ব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকারি সংস্থার ঋণ রয়েছে। সরকারি সংস্থার ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০৫ কোটি ডলারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি হারে সুদ ও কঠিন শর্তে নেওয়া এসব ঋণ সরকারি সংস্থাগুলোর দেওয়া পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। চাপে পড়ছে মানুষ। যেমন ঢাকা ওয়াসা সাতটি প্রকল্পে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদেশি ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে পানির দাম বাড়াচ্ছে সংস্থাটি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধ বাড়তে থাকবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ তা দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলারে। এরপর ঋণ শোধ কমতে থাকবে।
সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এই সব ঋণ নেওয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি। কোনো কোনো প্রকল্পের ঋণের শর্ত ও এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সরকার বিদেশি ঋণ, বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয় ঋণের লাগাম টানার চেষ্টা শুরু করেছে। ইআরডি জানিয়েছে, দ্বিপক্ষীয় ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা যাচাই প্রক্রিয়া বাড়িয়েছে। গত জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে বিদেশি ঋণ কিছুটা কমেছেও।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল শুক্রবার ইআরডির কারও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিভাগটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের বিদেশি ঋণ নিয়ে হিসাব করে। আর ইআরডির হিসাব প্রকল্প সহায়তা নিয়ে। ফলে দুই হিসাব মিলবে না।
ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সুদাসল পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বাজেটে বড় একটি বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে ঋণ পরিশোধের জন্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ৩২২ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধ বাড়তে থাকবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ তা দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলারে। এরপর ঋণ শোধ কমতে থাকবে।
বিদেশি ঋণ ও ঋণ শোধের চাপ বাড়লেও রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। আট বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩৫ শতাংশ (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে)। কিন্তু রপ্তানি আয় ৬২, প্রবাসী আয় ৬০ ও বিদেশি বিনিয়োগ ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এই তিন খাতে আয় ঋণের অনুপাতে না বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের অনুপাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল প্রায় ৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা কমে ২৫ শতাংশে নেমেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, যা এখন ২ হাজার ৫২৪ কোটি ডলার (আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী হিসাবে তা ২ হাজার কোটি ডলারের কম)।
বর্তমানে দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও বড় ঘাটতি রয়েছে আর্থিক হিসাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫২৩ কোটি ডলার। আর জানুয়ারি শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩৫ কোটি ডলারে। এই ঘাটতির একটি কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়া।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, জিডিপি দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা যায় না। ঋণ শোধ করতে টাকা দরকার। বিদেশি ঋণ হলে ডলারও লাগে। ফলে দেখতে হবে রাজস্ব আয়ের অনুপাতে বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি কী। তিনি বলেন, জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের হার অত্যন্ত কম। আবার রাজস্ব আয়ের অনুপাতে বাংলাদেশের ঋণ ৩৮০ শতাংশের মতো। ফলে বাংলাদেশকে উচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশ বলা যায়।