ডলার–সংকটের সময় প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা

বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডলার–সংকটে ভুগছে। রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি ডলার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয়।

ডলার–সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয়েও (রেমিট্যান্স) উদ্বেগজনক খবর। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নমুখী। ভালো সূচকের মধ্যে রপ্তানি আয় ছাড়াও ছিল প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। সেই প্রবাসী আয়ও নিম্নমুখী হয়ে গেল।

সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসে দেশে প্রবাসী আয় কম এসেছে আগের জুলাই মাসের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ। যেমন আগস্টে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আর আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। পরিমাণের দিক থেকে এক মাসের ব্যবধানে দেশে প্রবাসী আয় কম এসেছে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।

প্রবাসী আয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া গতকালের তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যাচ্ছে, গত বছরের একই মাস অর্থাৎ আগস্টের তুলনায় প্রবাসী আয় কমছে আরও বেশি হারে। যেমন এবারের আগস্টে প্রবাসী আয় ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ কোটি ডলার কম এসেছে। গত বছরের আগস্টে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। গত ছয় মাসের মধ্যেই এই আগস্টে প্রবাসী আয় এসেছে সবচেয়ে কম।

‘বিদেশে লোক বেশি যাচ্ছেন অথচ প্রবাসী আয় কম আসছে দেশে—এ এক রহস্যই বটে। এর নেপথ্য কারণ সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে।’
মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি, মার্চে ২০২ কোটি, এপ্রিলে ১৬৮ কোটি, মে মাসে ১৬৯ কোটি এবং জুনে (ঈদুল আজহা ছিল) ২২০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল।

বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডলার–সংকটে ভুগছে। রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি ডলার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয়। প্রকট ডলার–সংকটের সময় প্রবাসী আয় কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের ওপর চাপও অব্যাহত থেকে যাচ্ছে।

ডলার

যেমন সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৯২০ কোটি ডলার। আর আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩০৬ কোটি ডলার। আবার চলতি সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করতে সুদসহ ১১০-১২০ কোটি ডলার। ফলে আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যাবে।

এদিকে ডলার-সংকট কাটাতে প্রবাসী আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগের কথা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক জানালেও খুব বেশি সুফল দেখা যাচ্ছে না। খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ায় প্রবাসী আয়ে টান পড়েছে। কারণ, হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠালে এখন ডলারের দাম ব্যাংকের তুলনায় বেশি পাওয়া যায়।

বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি, প্রবাসী আয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। নতুন এ দর গতকাল রোববার থেকে কার্যকর হয়। এর আগে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম ছিল ১০৯ টাকা। সে হিসাবে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম গতকাল থেকে ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে।

তবে খোলাবাজারে নগদ ডলার এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়। এতে ডলারের দামের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও খোলাবাজারের মধ্যে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এ কারণে খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, এ ব্যবধান অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা আরও কমে যেতে পারে। এর বিপরীতে হুন্ডির প্রতি আগ্রহ বাড়বে প্রবাসীদের। কারণ, ডলারের দাম যেখানে বেশি পাওয়া যাবে, প্রবাসীরা সেদিকেই ঝুঁকবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বরাবরের মতো আগস্টেও ৭ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় সংগ্রহকারী ইসলামী ব্যাংক। এর পরের অবস্থানে আছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক।

প্রবাসী আয় কমে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশে লোক বেশি যাচ্ছেন অথচ প্রবাসী আয় কম আসছে দেশে—এ এক রহস্যই বটে। এর নেপথ্য কারণ সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে।’

মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের পরিবর্তে অবৈধ পথে বেশি আগ্রহী এখন প্রবাসীরা। ফলে একটা শ্রেণি ডলার পাঠাচ্ছেন না। না পাঠিয়ে আরেকটা শ্রেণিকে বলছে আমি তোমার লোকের কাছে ডলার দিয়ে দিলাম, তুমি দেশে আমার পরিবারের কাছে টাকা পাঠিয়ে দাও। তা ছাড়া আছে বিনিময় হারের অস্থিরতা। এসব কারণেই প্রবাসী আয়ে টান পড়েছে, যা একধরনের অশনিসংকেত।’