বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক

ঋণখেলাপির নতুন নীতিমালার বাস্তবায়ন পেছানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

আগামী মাস থেকে ঋণখেলাপি হওয়ার নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। নতুন এই নীতিমালা অনুযায়ী, তিন থেকে এক বছর কোনো ঋণ অনাদায়ি থাকলে তা বিভিন্ন মানে খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে। আগে বিভিন্ন ধরনের ঋণ সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত অনাদায়ি থাকলে তা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হতো। নতুন নীতিমালায় সেই সময় কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।

ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন এই নীতিমালা কার্যকর হলে তাতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, সর্বশেষ গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। তাতে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ঋণ তিন মাস অনাদায়ি থাকলেই তা নিম্নমানের, ৬ মাস অনাদায়ি থাকলে তা সন্দেহজনক ও ১২ মাস অনাদায়ি থাকলে ক্ষতিজনক ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে এখনই এই নীতিমালা বাস্তবায়ন না করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা এই নীতিমালা বাস্তবায়ন ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এরই মধ্যে একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠন বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন। আবার কোনো কোনো সংগঠন লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ শ্রেণীকরণের এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই খেলাপি হয়ে যাবে। তাতে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রুগ্‌ণ শিল্পে পরিণত হবে।

যা বলছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সম্প্রতি এক চিঠিতে গভর্নরকে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ের ঋণের উচ্চ সুদ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক উদ্যোক্তার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা কিছুটা শিথিল করা দরকার।

সংগঠনটির সভাপতি তাসকীন আহমেদ চিঠিতে বলেন, নতুন ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা আগামী ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি অনেক বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানও সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। তাই শিল্পের ঋণ পুনঃ তফসিলের সুবিধার পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো দরকার। ঢাকা চেম্বার নতুন ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালার কার্যকারিতা আরও ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সংগঠনটি মনে করছে তাতে বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পও উপকৃত হবে।

এদিকে তেল মিলের মালিকদের সংগঠন এক চিঠিতে জানিয়েছে, গত ৫০ বছরে তাঁদের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো ঋণখেলাপি হয়নি, এমনকি সুদ মওকুফের আবেদনও করেনি; কিন্তু গত কয়েক বছরে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ও দেশে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিনির্ভর এই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অনেকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

এ ছাড়া বিগত সরকারের সময় কিছু ব্যবসায়ী ক্ষমতার অপব্যবহার করে একতরফা ব্যাংকিং–সুবিধা নিয়েছে। এতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের আর্থিক সক্ষমতা হারায়। এ কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই ঋণ শ্রেণীকরণের নীতিমালার বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তেল মিলের মালিকেরা।

নীতিমালায় আরও যা আছে

বর্তমানে ব্যাংকঋণের ধরন ও খাত বিবেচনায় ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার এক বছর পর পর্যন্ত গ্রাহক খেলাপি না হওয়ার সুযোগ পান। কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৯ মাস পর তা খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। কৃষিঋণের ক্ষেত্রে ১৫ মাস পর্যন্ত কিস্তি বকেয়া থাকলেও ঋণগ্রহীতা কৃষককে খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। শিল্পঋণের ক্ষেত্রে চলতি ঋণ, মেয়াদি ঋণ ও ডিমান্ড ঋণের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের পর সেসব ঋণ খেলাপি হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, সব ধরনের ঋণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত দিনের পরবর্তী দিন থেকে তা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসেবে গণ্য হবে।

নতুন নীতিমালায় ঋণখেলাপি হওয়ার সময়সীমা কমিয়ে আনার পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হারও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। ফলে নতুন নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাওয়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন নিয়মে নিয়মিত ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ স্থিতির ওপর ১ শতাংশ, ‘স্পেশাল মেনশন’ হিসাবের ক্ষেত্রে ঋণ স্থিতির ওপর ৫ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। ঋণ অনাদায়ি হওয়ার দুই-তিন মাস সময়কে ‘স্পেশাল মেনশন’ হিসেবে গণ্য করা হবে।

এ ছাড়া বিরূপ মানে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার হবে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ও মন্দ বা ক্ষতিজনক মানের খেলাপির ক্ষেত্রে সঞ্চিতির হার হবে শতভাগ। রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও বড় ঋণখেলাপিদের চাপে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ–সংক্রান্ত নীতিমালা শিথিল করেছিল।

ব্যাংকাররা বলছেন, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে তাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতির কারণে ব্যাংকের মুনাফায়ও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। মূলত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত এই চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।