মজুত কম থাকায় ও চাহিদা অনুসারে মোড়কজাত করতে না পারার কারণে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) এক সপ্তাহ ধরে সাধারণ গ্রাহকের মধ্যে চিনি (লাল চিনি বলে পরিচিত) বিক্রি বন্ধ রেখেছে। এ অবস্থা আরও সপ্তাহখানেক চলবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
নিম্ন আয়ের মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে চিনি দিতে রাজধানীর মতিঝিলে বিএসএফআইসি ভবনের নিচতলায় নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে চিনি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। এখান থেকে মোড়কজাত প্রতি কেজি চিনি ৯২ টাকা দরে দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত কিনতে পারেন গ্রাহকেরা। খোলাবাজারে এই চিনিই ১২০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। ফলে কম দামে কিনতে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ নিয়মিত বিএসএফআইসি ভবনে ভিড় জমান।
সোমবার রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ভবনে চিনি কিনতে যান রাজধানীর কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা সেলিম মজুমদার। কিন্তু ভবনে ঢুকতেই তাঁর চোখে পড়ে নোটিশ, যাতে লেখা রয়েছে—অনিবার্য কারণবশত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আপাতত চিনি বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
নিরুপায় হয়ে চিনি পাওয়ার আশায় বিএসএফআইসিতে কর্মরত পূর্বপরিচিত এক কর্মকর্তাকে ফোন করেন তিনি। কিন্তু তাতেও হতাশ হতে হয় তাঁকে। ওই কর্মকর্তা জানান, এখন চিনি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আগামী মাসের শুরুতে চিনি কলগুলো উৎপাদনে গেলে সাধারণ গ্রাহকেরা বিএসএফআইসির কাছ থেকে চিনি কিনতে পারবেন। এরপর হতাশ হয়ে ফেরার পথ ধরেন সেলিম।
এ সময় জানতে চাইলে সেলিম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে দুই দিন এসে চিনি না পেয়ে ফিরে গেছি। আজকে (সোমবার) আবার এসেছি। কিন্তু আজও চিনি পেলাম না।’ সেলিম মজুমদারের মতো এমন অনেক গ্রাহকই কয়েক দিন ধরে বিএসএফআইসিতে গিয়ে চিনি না পেয়ে ফিরে গেছেন।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বলেন, ‘এখন বছরের শেষ সময়। এ কারণে মজুত শেষের দিকে। এ ছাড়া চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে চিনিকলগুলোতে নতুন চিনি উৎপাদন মৌসুম শুরু হবে। ফলে কাজের চাপে গ্রাহক পর্যায়ের জন্য চিনি মোড়কজাত কার্যক্রমের গতি কমে গেছে। এ কারণে বর্তমানে আমাদের বিক্রয়কেন্দ্রে চিনি বিক্রি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। নতুন চিনি উৎপাদন শুরু হলেই আবার বিক্রি শুরু হবে।’
কর্মকর্তারা জানান, বিএসএফআইসির উৎপাদিত চিনির প্রায় ৬০ শতাংশ দিতে হয় অত্যাবশ্যকীয় খাত হিসেবে বিবেচিত সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। অবশিষ্ট চিনির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মোড়কজাত করে স্বপ্ন, আগোরাসহ বিভিন্ন সুপারশপগুলোতে সরাসরি বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনি প্যাকেটজাত করে বিএসএফআইসি ভবনের নিচতলায় নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি।
এ ছাড়া অনুমোদিত ডিলাররা বিএসএফআইসির কাছ থেকে চিনি কিনে বাজারজাত করেন। একজন ডিলার ৮৫ টাকা কেজি দরে বছরে তিন–চারবার চিনি নিতে পারেন। একজন ডিলারের কাছে প্রতিবারে ২৫০ কেজি করে চিনি বিক্রি করা হয়।
বিএসএফআইসির কর্মকর্তারা জানান, কয়েক বছর ধরে দেশে আখমাড়াই ও চিনি উৎপাদনের পরিমাণ কমেছে। এ জন্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে গ্রাহক পর্যায়ে। ২০২১–২২ অর্থবছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চিনি উৎপাদিত হয়েছে ২৪ হাজার ৫০৯ টন। এর আগের অর্থবছরে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন। এর বিপরীতে সেবার চিনি উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৮ হাজার ১৩৪ টন। আর ২০১৯–২০ অর্থবছরে চিনি উৎপাদন হয় ৮২ হাজার ১৪০ টন। অর্থাৎ দেশে প্রতিবছরই চিনি উৎপাদন কমছে।
এ ছাড়া সর্বশেষ ২০২১–২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আখমাড়াই হয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬৭৪ মেট্রিক টন। যেখানে ২০১৯–২০ অর্থবছরে আখমাড়াই হয়েছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টনের বেশি।
অন্যদিকে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। মূলত আখের উৎপাদন কমায় ও ছয়টি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিনি উৎপাদন কমেছে বলে জানিয়েছেন বিএসএফআইসি সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার।
প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চিনির উৎপাদন কমায় সাধারণ গ্রাহকসহ বিভিন্ন খাতে চাহিদা অনুসারে চিনি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অত্যাবশ্যকীয় খাতে (বাহিনীগুলো) বছরে প্রায় ৩২ হাজার টন চিনি সরবরাহের চাহিদা থাকে। সেখানে ছয় মাস ধরে চিনি দেওয়া হচ্ছে না। ডিলাররাও চাহিদা অনুসারে চিনি পাচ্ছেন না। আর এখন সাধারণ গ্রাহকদের জন্যও সাময়িকভাবে চিনি বিক্রি বন্ধ রয়েছে।